২২ জানুয়ারি থেকে নানা বর্ণিল আয়োজনে বসন্ত উৎসব ও চান্দ্র নববর্ষ উদযাপন করছেন চীনের মানুষ।
চীনের বাইরেও পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা চীনারা সমান উৎসাহে উদযাপন করছেন তাদের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যিক এ উৎসবটি। চীনাদের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চীনা সংস্কৃতি প্রেমিরাও নানাভাবে যোগ দেন এ আয়োজনে।
এমনই একটি নান্দনিক আয়োজন ‘চাইনিজ ব্রিজ চাইনিজ দক্ষতা প্রতিযোগিতা - ক্যালিগ্রাফি ও পেইন্টিং চ্যালেঞ্জ’শীর্ষক প্রতিযোগিতাটি- যেখানে তুলির আঁচড়ে- চিত্রকলায় আর চীনা ক্যালিগ্রাফিতে চীনা চান্দ্র নববর্ষকে মূর্ত করেছেন শিল্পীরা।
বসন্ত উৎসবের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ সিংহনৃত্য। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শিল্পী হিন্দ মোহাম্মদ সাইদ বাল্লা আল নুয়াইমির তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন সেই রাজসিক সিংহমূর্তি।
বসন্ত উৎসবের আরেকটি প্রধান বিষয় পারিবারিক পুনর্মিলন ও বিশেষ ভোজ। মিসরের শিল্পী হাবিবা মেধাত আবদেল হাকিম তা-ই ফুটিয়ে তুলেছেন তার চিত্রকর্মে।
এবার চীনা চান্দ্র নববর্ষ হচ্ছে খরগোশ বর্ষ। কানাডার শিল্পী কালৌ ড্যানিয়েল, স্পেনের সিলভিয়া ডি টরেস আরিলো এবং বাংলাদেশের তাসনুভা জেরিন হকের তুলিতে মূর্ত হয়েছে খরগোশের মূর্তি।
চীনের ক্যালিগ্রাফি ও পরিবেশ-প্রকৃতির ছবিও ফুটে উঠেছে অনেক শিল্পীর তুলিতে।
চমৎকার এ আয়োজনটি মাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা শিল্পীরা যেমন নিজেদের শৈল্পিক দক্ষতা দেখাতে পেরেছেন তেমনি নিজেরাও ঐতিহ্যগত চীনা ক্যালিগ্রাফি এবং চিত্রকলার গভীর উপলব্ধি অর্জন করেছেন।
প্রতিবেদন: মাহমুদ হাশিম
সিএমজি’র বর্ণাঢ্য স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল গালা-২০২৩
বর্ণাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল চীনা বসন্ত উৎসবের সেরা চমক বহুল প্রতীক্ষিত সিএমজি স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল গালা নাইট ২০২৩। গালার এই আয়োজন উপভোগ চীনাদের উৎসবের অন্যতম একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘শত শত পাখি নিড়ে ফিরে’ এই গান এবং নাচের মধ্য দিয়ে একটি দুর্দান্ত ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতিকে পরিচয় করিয়ে দেয় হয়। গান এবং নাচ ছাড়াও কমেডি স্কেচ, অ্যাক্রোব্যাটিক্স ও পিকিং অপেরাসহ চীনের ঐতিহ্যিক নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে চমকপ্রদ পারফরম্যান্সের মাধ্যমে।
২২ জানুয়ারি বেইজিং সময় রাত ৮টায় শুরু হয়ে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা পর্যন্ত চলে এই গ্র্যান্ড গালার আয়োজন। এই অনুষ্ঠানটি চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশন সিসিটিভি, সিজিটিএনসহ একাধিক টিভি চ্যানেল, রেডিও স্টেশন, বেশ কয়েকটি নতুন মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এবং সোসাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
‘শত শত পাখি নিড়ে ফিরে’ এই গান এবং নাচের মধ্য দিয়ে একটি দুর্দান্ত ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতিকে পরিচয় করিয়ে দেয় হয়- যা ক্যান্টোনিজ নামিয়ামের উপর ভিত্তি করে পরিবেশিত হয়।
পরে "ড্রাগন ফ্লাইং ওভার চায়না" থিমে অ্যাক্রোবেটিক পারফরম্যান্স উপস্থাপন করে উত্তর চীনের হ্যপেই প্রদেশের ছাংচৌ শহর এবং উত্তর-পূর্ব চীনের চিলিন প্রদেশের চিলিন শহর থেকে আশা অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা। থাং রাজবংশের আমলের চীনা সেনাবাহিনীর একটি সামরিক প্রশিক্ষণের উপর ভিত্তি করে নিখুঁত দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে এই পারফরম্যান্সটি করা হয়।
এ ছাড়া পিকিং অপেরা, চীনা মার্শাল আর্ট এবং ঐতিহ্যবাহী নৃত্যের উপাদান, ১০টি নতুন বিষয়ের পরিবেশনাসহ ৪০টি হৃদয়গ্রাহী আয়োজন গালা অনুষ্ঠানটিকে শুধু সমৃদ্ধই করেনি বরং একটি উচ্চ-মানের সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী দর্শকদের কাছে চীনের সৌন্দর্্যের একটি দুর্দান্ত প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে বলে মনে করেন চীনারা।
ম্যারাথন বৈচিত্র্যের শো’টি দর্শকদের উৎসবের চূড়ান্ত পর্যায়ের আনন্দে মাত্রা যোগ করে, যখন নববর্ষের ঘণ্টা বেজে ওঠে এবং চীনের শেনচৌ-১৫ মহাকাশযান মিশনের ক্রুরা মহাকাশ থেকে তাদের শুভেচ্ছা পাঠান।
ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও শিল্পকলাকে উদ্ভাবনী আকারে উপস্থাপন করতে অত্যাধুনিক ভিজ্যুয়াল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতিবারের মতো এবারও অনুষ্ঠানটি চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ উপভোগ করেন। এর মাধ্যমে চীনাদের ঐতিহ্যিক নববর্ষের আনন্দ আর সম্প্রীতি ছড়িয়ে পরে সবখানে।
১৯৮৩ সালে শুরুর পর থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দেখা টিভি অনুষ্ঠান হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস দ্বারা স্বীকৃত, অনুষ্ঠানটি প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন দর্শক উপভোগ করে আসছেন।
প্রতিবেদন: রওজায়ে জাবিদা ঐশী।
চিরায়ত চীনা সাহিত্য
গীতিধর্মী কাব্যের কবি পাই চু ই
চীনের থাং রাজবংশের সময়ের কবিতাকে বলা হয় থাংশি। শি মানে কবিতা। থাং রাজবংশের সময় চীনে অনেক বিখ্যাত কবির জন্ম হয়েছে। এমনি একজন বিখ্যাত কবি হলেন পাই চু ই।
চীনের বর্তমান শানসি প্রদেশের থাইইয়ুয়ান শহরে তার জন্ম ৭৭২ খ্রিস্টাব্দে। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। তবে পণ্ডিত হিসেবে তাদের পরিবারের খ্যাতি ছিল। পাই চু ইর শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে হ্যনান প্রদেশের চাংইয়াং শহরে।
কবি পাই চু ই।
দশ বছর বয়সের সময় তাকে পরিবারের থেকে দূরের এক শহরে আত্মীয় বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কারণ সেসময় উত্তর চীনে যুদ্ধ দেখা দিয়েছিল। তাকে দক্ষিণে সুচৌ শহরের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারুণ্যে তিনি সরকারি চাকরি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে ছোট একটি পদে চাকরি জীবন শুরু করেন।
তিনি দরবারের জটিলতায় পড়ে যান এবং তার অনেক শত্রু সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ সম্রাটের বিরাগভাজন হয়ে নির্বাসনে যেতে হয় তাকে। পরে অবশ্য নতুন সম্রাটের আমলে আবার দরবারে ফিরে আসতে পারেন।
৮২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সুচৌ শহরের গভর্নর নিযুক্ত হন। এর কিছুকাল পরে তিনি অবসরে যান। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। শেষ জীবনে মঠে জীবন কাটান। পাই ই চু দুই হাজার আটশো’র বেশি কবিতা লিখেছেন। তার কবিতা চীন ও জাপানে সমান জনপ্রিয়তা পায়।
পাইয়ের কবিতা সরল এবং সহজে বোধগম্য হওয়ায় জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেও অনেক কবিতা লিখেছেন। সমসাময়িক সামাজিক অবিচার, দুর্নীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে তার পরিহাসমূলক কবিতাগুলো সমাজের অসংগতিকে তীব্রভাবে আঘাত করেছে।
আবার প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাগুলো স্নিগ্ধ সারল্য পাঠকের মন জয় করেছে।
৮৮৬ সালে পাই চু ই মৃত্যুবরণ করেন। হ্যনান প্রদেশের সিয়াংশান মন্দিরের প্রাঙ্গণে তার সমাধি রয়েছে।
পাই ই চুর একটি বিখ্যাত কবিতা এখানে শ্রোতাদের শোনাচ্ছি।
দক্ষিণ তীরের স্বপ্ন
সুন্দর দক্ষিণ তীর
দৃশ্য তার মনোমুগ্ধকর
সূর্যোদয়ের সময় ফুলগুলো আগুনের চেয়ে রক্তিম হয়ে ওঠে
বসন্তে সাগরের সবুজ ঢেউ যেন নীলাকান্তমণির চেয়েও সুনীল
আমি তার প্রশংসা না করে থাকতে পারি না।
থাং রাজবংশের সময়কার কবি পাই চু ই তার পরবর্তিকালের কবিদের রচনায় প্রভাব বিস্তার করেছেন। তার কবিতার গীতিধর্মী দ্যোতনা অন্য কবিদেরও প্রকৃতির বর্ণনামূলক কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------
চীনের সংস্কৃতি চীনের ঐতিহ্য
অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ
প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম।
সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী।