বধির মেয়ে চেং স্যুয়ান এখন পিএইচডি ডিগ্রিধারী ভাষাবিজ্ঞানী
2023-01-23 14:59:49

প্রতিবন্ধীরা সমাজের বিশেষ একটি গোষ্ঠী। যারা মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল, তারা প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত হয়। সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে চীনে প্রতিবন্ধীর মোট সংখ্যা সাড়ে ৮ কোটির বেশি। তাদের জীবন স্বাভাবিকভাবেই  সাধারণ মানুষের তুলনায় বেশি কষ্টকর ও চ্যালেঞ্জিং। তাই চীনা প্রতিবন্ধীদের স্বাভাবিক জীবনমান ও অধিকার নিশ্চিত করতে অনেক আগেই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

    আজকের অনুষ্ঠানে আমরা একজন বধির মেয়ের গল্প তুলে ধরবো, যিনি নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং চীনের প্রথম বধির পিএইচডি ডিগ্রিধারী ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর গল্প বেশ মনোমুগ্ধকর ও উত্সাহব্যঞ্জক। চলুন, তাঁর গল্প শুনি।

    চেং স্যুয়ান বেইজিং নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি চীনের প্রথম বধির শিক্ষার্থী যিনি ভাষাবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেছেন। ২ বছর বয়সে জ্বরের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বধির হয়ে যান। পরে কঠোর চর্চার পর তিনি ইশারা ভাষা শেখেন। তিনি চীনের উহান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জনের পর ফুতান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন।

    ডক্টর চেংকে দেখে বধির বাচ্চাদের বাবা-মারা উত্সাহিত হন এই ভেবে যে, তাদের বাচ্চারাও চেংয়ের মতো জীবনে সফল হতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারে। তবে, চেং স্যুয়ান নিজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বলেন, মুখ দিয়ে কথা বলার জন্য তিনি অনেক কষ্ট ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন এবং বড় হওয়ার পর যখন মুখ দিয়ে কথা বলতে শুরু করেন, তখন অনেকে ভয় পেতো, কারণ তার অনেক শব্দের উচ্চারণ বোধগম্য ছিল না। পরে তিনি ইশারা ভাষা শেখেন। ফলে তার জন্য অন্যদের সাথে যোগাযোগ করা সহজতর হয়।

    ২ বছর বয়সে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। একটি ওষুধ খাওয়ার পর তার শ্রবণশক্তি প্রায় নষ্ট হয়ে যায়। সেই সময় তিনি কিছু কথা বলতে পারতেন। মানে, মোটামুটি কথা বলা শেখার পর তিনি বধির হয়ে যান। ফলে, তার জীবন অন্য বধিরদের তুলনায় খানিকটা সহজ হয়।

    পরিবারের প্রত্যেক সদস্য মেয়ে চেং স্যুয়ানের স্বাভাবিক জীবনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তারা চেংয়ের জন্য শ্রবণযন্ত্র কেনেন এবং তাকে কথা বলা শেখাতে চেষ্টা করেন। ছোটবেলায় মুখের কথা শেখার অভিজ্ঞতা চেংয়ের মনে গভীর দাগ কাটে। বাবা-মা প্রতিদিন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে একটি শব্দ হাজার বার উচ্চারণ করতেন, যাতে তিনি উচ্চারণটি বুঝতে ও বলতে পারেন। একটি শব্দের উচ্চারণ শিখতে অনেক দিন ধরে চর্চা করতে হতো। কিছু কিছু উচ্চারণ তিনি সহজে ধরতে পারতেন না, যা চেংয়ের জন্য অনেক কষ্টকর ব্যাপার ছিল।

    প্রাথমিক পর্যায় থেকেই মেয়ে চেং স্যুয়ান স্বাভাবিক স্কুলে ভর্তি হয়। শ্রবণযন্ত্র ও মনোযোগী পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সে আশেপাশের লোকদের কথার অর্থ বুঝতে চেষ্টা করে। তাঁর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক বলেন, যখন ক্লাস হতো, তখন মেয়ে চেং মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শোনার বা বোঝার চেষ্টা করতো।  মাঝে মাঝে সে শিক্ষকদের কথা বুঝতে পারতো না। তখন শিক্ষকদের সাথে কথা বলতে সে ভয় পেতো।

    অনেক সময় দেখা যেতো ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা সবাই শিক্ষকদের কথা শুনতে বুঝতে পেরেছে, শুধু চেং স্যুয়ান শ্রবণশক্তির দুর্বলতার কারণে বুঝতে পারে নাই। সেই সময় তাকে পড়াশোনায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হতো। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সাথেও শুধু কাগজে লিখে লিখে মনের ভাব প্রকাশ করতো সে। সে অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ হলে চেংয়ের মনে এখনও দুঃখ হয়।

    বর্তমানে চেং নিজের অবস্থাকে তুলনামূলকভাবে সহজভাবে নিয়েছেন। বড় হওয়ার পর আরো বেশি বধির বন্ধুর সাথে তার পরিচয় হয় এবং ইশারা ভাষা দিয়ে তিনি সবার সাথে অবাধে কথাবার্তা বলতে শুরু করেন, যেটি তাঁর জন্য বেশ আনন্দের অভিজ্ঞতা ছিল। সাধারণ মানুষ তাঁর কথা বুঝতে পারেন না, তবে বধির বন্ধুরা ঠিকই তাঁর ইশারা ভাষা বুঝতে পারে।

    পরে তিনি হুপেই প্রদেশের প্রতিবন্ধীদের শিল্পকলা দলে যোগ দেন এবং আরো বেশি বধির বন্ধুর সাথে পরিচিত হন। দীর্ঘকাল ধরে তিনি স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের সাথে পড়াশোনা করেছেন এবং মুখ দিয়েও মোটামুটি কথা বলতে পারেন। সেটি অন্য বধিরদের সাথে তাঁর একটা পার্থক্য রচনা করেছে। তখন একটা নতুন সংকট সৃষ্টি হয়। এই সংকট ‘পরিচিতি সংকট’। বধিরদের দৃষ্টিতে তিনি সাধারণ মানুষের সাথে তাদের চেয়ে সহজে ভাব বিনিময় করতে পারেন; আর সাধারণ মানুষদের দৃষ্টিতে তাঁর শ্রবণশক্তি দুর্বল। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর কিছু মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়। তখন শিক্ষক তাকে বলেন, ‘তোমার প্রিয় ও আরামদায়ক পদ্ধতিতে জীবন কাটাও। মুখের কথায় হোক বা ইশারা ভাষায় হোক, অবাধে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা অতি গুরুত্বপূর্ণ।’ তখন তিনি মনে শান্তি পান এবং ইশারা ভাষায় আরও দক্ষতা অর্জন করেন।

    ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করার পর তিনি ছোংছিং নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চাকরি নেন। তাঁর ক্লাসে ৮০ জন বধির শিক্ষার্থী ছিল। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের পিতামাতারা আশা করেন, তাদের বাচ্চারা শিক্ষক চেংয়ের মতো কথা বলায় দক্ষতা অর্জন করবে এবং সাধারণ মানুষের মতো জীবন কাটাতে সক্ষম হবে।

    বধির বাচ্চাদের যদি বিশেষ ভাষা শেখানো না-হয়, তবে তাদের বুদ্ধি অন্যদের তুলনায় কম বিকশিত হবে। শিক্ষক চেং ২ বছর বয়সে শ্রবণশক্তি হারান। তাই অন্য বধির বাচ্চাদের চেয়ে তার অবস্থা একটু আলাদা। তা ছাড়া, তার পরিবারের প্রত্যেক সদস্য তার মুখের ভাষা বোঝার জন্য নিজেরা অনেক চেষ্টা করেছেন এবং তিনি শ্রবণযন্ত্র ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছেন। তাই চেংয়ের অভিজ্ঞতা সব বধির বাচ্চার জন্য প্রযোজ্য নয়।

    বধির পিতামাতাদের নিজেদের বাচ্চাদের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ সম্পর্কে শিক্ষক চেং মনে করেন, বধির বাচ্চাদের ইশারা ভাষা ভালো করে শেখা তাদের জীবনের জন্য জরুরি। এভাবে তারা অবাধে অন্যদের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে। ইশারা ভাষা শেখা মুখে কথা বলা শেখার চেয়ে সহজ। ইশারা ভাষায় স্পষ্টভাবে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। তিনি স্বাভাবিক লোকজনকেও ইশারা ভাষা শিখতে উত্সাহ দেন, যাতে তারা বধির লোকজনের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে।

    ইশারা ভাষা একটি সম্ভাবনা। বধির বাচ্চারা ছোটবেলা থেকে এ ভাষার চর্চা শুরু করলে, সেটা তাদের জন্য ভালো। কারণ, ইশারা ভাষা আসলে একটি ভিন্ন ভাষার মতোই। স্বাভাবিক বাচ্চারাও ছোটবেলায় ইশারা ভাষা শিখে ফেললে, তাদের একটি অতিরিক্ত ভাষা শেখা হয়ে যাবে। বড় হওয়ার পর তাদের সামনে কাজের সুযোগ বেশি হবে।

    একজন বধির অধ্যাপক হিসেবে ডক্টর চেং বধিরদের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দুটি বিষয় খেয়াল করেছেন। যাদের শ্রবণশক্তি কম, এমন বধিররা মুখের ভাষা শিখতে বেশ আগ্রহী হয়। তারা চায় ইশারা ভাষা ও মুখের ভাষা শিখে অনেক বেশি মানুষের সাথে ভাব বিনিময় করতে। আর যাদের শ্রবণশক্তি একেবারেই নেই, তারা ইশারা ভাষা ব্যবহারে বেশি অভ্যস্ত হয়। তবে, বর্তমানে ইশারা ভাষায় যেসব পাঠ্যপুস্তক পাওয়া যায়, সেগুলো যথেষ্ঠ নয়। অনেক শব্দ বধিরদের জন্য সুবিধাজনক নয়।

    এ সম্পর্কে শিক্ষক চেং বলেন, ১৮৮৭ সালে চীনের প্রথম বধির স্কুল চালু হয়। বিভিন্ন প্রদেশের আঞ্চলিক ভাষার পার্থক্যের কারণে উহান, ছোংছিং বা শাংহাইয়ের ইশারা ভাষার শব্দের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। তা ছাড়া, অনেক ইশারা ভাষার শব্দ অভিধানে পাওয়া যায় না।

    ২০১৮ সালের মে মাসে চীনে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইশারা ভাষার প্রথম অভিধান প্রকাশিত হয়। এ বই রচনার সময় অনেক বধিরের পরামর্শ নেওয়া হয়। তবে, এখনও অনেক শব্দের প্রকাশভঙ্গি একেক জায়গায় একেকরকম, যা একটি সমস্যা।

    ২০২০ সালে অধ্যাপক চেং স্যুয়ান বেইজিং নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নতুন চাকরি নেন। বেইজিংয়ে আসার পর তিনি ইশারা ভাষা ও বধির প্রশিক্ষণ নিয়ে গবেষণাকাজে কর্মরত আছেন। গত কয়েক বছরে তিনি বিভিন্ন ফিল্ড জরিপের কাজ করেন। বধিরদের প্রশিক্ষণে আরো প্রচেষ্টা চালাবেন এবং তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও আত্মউন্নয়নের জন্য আরো বেশি সুযোগ খোঁজার চেষ্টা করবেন বলে জানালেন অধ্যাপক চেং।(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)