চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য- ০০১
2023-01-21 19:33:42



বসন্ত ও বর্ষবরণের উৎসব-মুখরতায় চীন

                                             

চীনের রাজধানী বেইজিং থেকে শুরু করে পূর্ব চীনের আনহুই প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম হংচুন- গোটা চীন জুড়ে বসন্ত-বরণের উৎসবমুখরতা!

করোনা মহামারির তিন বছরের বিচ্ছিন্নতাকে অতিক্রম করে গোটা চীনের মানুষ মেতে উঠেছেন নিজেদের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যিক ও জমকালো বসন্ত উৎসব উদযাপনে।

বসন্ত উৎসব উদযাপন এবং চীনা চান্দ্র নববর্ষকে স্বাগত জানাতে নানা বর্ণিল সাজ আর আয়োজনে ঝলমল করছে গোটা চীন।

বসন্ত উৎসবের অন্যতম অনুসঙ্গ লাল লণ্ঠন। নানা আকৃতি আর রঙের লণ্ঠনের বর্ণবিভা নিয়ে আসে উৎসবের আমেজ।

উত্তর চীনের শানসি প্রদেশের প্রাচীন শহর পিন্কইয়াওয়ের বাসিন্দা ওয়াং হুইচিয়া শেষ মুহূর্তে ব্যস্ত সময় পার করছেন লণ্ঠনসজ্জার কাজে। তিনি বলেন, ‘প্রাচীন এ শহরটিতে নববর্ষের সাজসজ্জায় আমরা দ্রুত লণ্ঠন লাগানোর কাজ শেষ করতে চাইছি। কারণ আমরা চাই পিঙ্কইয়াওতে আসা পর্যটকরা যেন বসন্ত উৎসবের আমেজ এবং পরিবেশটা যথাযথভাবে দেখতে ও অনুভব করতে পারেন’।

উত্তর চীনের হ্যপেই প্রদেশে গ্রাম থেকে বসন্ত উৎসবের কেনাকাটা করতে কাংচৌ শহরে আসা লু কওফেংয়েরও খুব   পছন্দ লণ্ঠন। তিনি বলেন, ‘বসন্ত উৎসব চলে এসেছে। আমি এ জন্য কেনাকাটা করতে শহরে এসেছি। আমি অনেক কিছু কিনেছি। এই ছোট লণ্ঠনটি উৎসব-উৎসব ভাব নিয়ে আসে এবং পরিবেশকে অনেক বেশি উৎসবমুখর করে তোলে’।

বসন্ত উৎসবের সাজসজ্জ্বার আরেকটি প্রধান অনুষঙ্গ শুভেচ্ছাজ্ঞাপক নানা বর্ণিল কাপলেট। এর সঙ্গে চীনা অক্ষরে লেখা ফু শব্দটি শোভা পায় বিভিন্ন স্থানে। চীনা ভাষায় ফু শব্দের অর্থ সৌভাগ্য।

 

নানা নকশায় রঙিন পেপারকাট বসন্ত উৎসবের আরেকটি প্রধান সজ্জা-উপকরণ।

বসন্ত উৎসবে সাজসজ্জার পাশাপাশি গোল্ডেন হলিডিতে পারিবারিক পুনর্মিলন একটি চীনাদের বিশেষ ঐতিহ্য।

বেইজিংয়ের এক নারী বলেন, ‘২০২৩ সালে বসন্ত উৎসবে আমার কাছে মূল কথা পুনর্মিলন। তিন বছর ধরে মহামারি সঙ্গে লড়াইয়ের পর আমি আমার পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছি’।

নববর্ষের আগের রাতে এবং গোটা বসন্ত উৎসব জুড়ে থাকে নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবারে আয়োজন। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে খাবার খাওয়া চীনাদের একটা রীতি। 

খরগোশ বর্ষ হওয়ায় লন্ঠন, বিভিন্ন পণ্য ও সাজসজ্জার উপকরণেই শুধু খরগোশের প্রতিকৃতি প্রাধান্য পেয়েছে এমন নয়, নানা খাবার এমনি পেস্ট্রিও তৈরি হচ্ছে খরগোশের আদলে।

বসন্ত আর নববর্ষ উদযাপনে চীনজুড়ে আয়োজিত হচ্ছে নানা ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শুধু রাজধানী বেইজিংয়েই আয়োজিত হচ্ছে ৪ হাজার বেশি অনুষ্ঠান। এর মধ্যে নানা ধরনের মেলা, অর্কেস্ট্রা-বাদন, সিংহ নৃত্য, পাপেট শোসহ নানা ঐতিহ্যিক আয়োজন রয়েছে।

 

আর নববর্ষে বর্ণাঢ্য সিএমজি গালা দীর্ঘ দিন ধরেই চীনাদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ।

মহামারি কাটিয় নতুন করে উৎসাহ-উদ্দীপনায় চীনা বসন্ত উৎসব উদযাপনে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ভিডিও লিঙ্কে চীনের বিভিন্ন স্থানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে বসন্ত উৎসবের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট সি বলেন, ‘সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আমি চীনের সকল জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, হংকং, ম্যাকাও, তাইওয়ান ও বিদেশে আমাদের সকল স্বদেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমি আপনাদের সুস্বাস্থ্য  , সুখ, পেশাগত উন্নতি এবং খরগোশ বর্ষে সৌভাগ্য কামনা করছি। আমি আশা করি আমাদের দেশ সমৃদ্ধি অর্জন করবে এবং আমাদের জনগণ শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করবে’।

প্রতিবেদন: মাহমুদ হাশিম।


চিরায়ত চীনা সাহিত্য

কবি সুই হু এবং এক বসন্তের দিনে

বসন্ত ঋতু চীনের প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিদের অধিকাংশের কবিতায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছে। থাং রাজবংশের সময়কে বলা হয় চীনা কবিতার স্বর্ণযুগ। এ যুগের একজন বিখ্যাত কবি সুই।

সুই হুর জন্ম ৭৭২ খ্রিস্টাব্দে বোরিংয়ের সুই পরিবারে। তার আরেক নাম হচ্ছে ইন কুং। সুই হুর প্রেম এবং বসন্ত নিয়ে একটি বিখ্যাত কবিতা চীনা সাহিত্যের কিংবদন্তি।

তরুণ বয়সে সুই হু রাজকীয় চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ছাংআন শহরে যান। তবে পরীক্ষায় তিনি ফেল করেন। এ সময় কিছুটা শান্তি পাওয়ার আশায় তিনি ছাংআন শহরের উপকণ্ঠে নানচুয়াং নামের গ্রামে যান। তৃষ্ণার্ত অবস্থায় এ গ্রামের একটি বড় বাড়িতে তিনি প্রবেশকরে পানি চান।                                               

সেখানে সেই পরিবারের একটি মেয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়। মেয়েটি সুন্দরী, অভিজাত, ভদ্র। সেই তরুণী সুই হুকে চা পরিবেশন করেন। সুই হু চা খেতে খেতে দেখতে পান বাড়ির ভিতরের বাগানে সেই তরুণী একটি পুষ্পিত পিচ গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সুই হুর চোখে চোখ পড়ার পর তার ঠোঁটে সিন্গ্ধ হাসি ফোটে। সুই হু প্রথম দেখাতেই মেয়েটির প্রেমে পড়েন।

 

এরপর সুই হু পরের বছর শহরে এসে রাজকীয় চাকরির পরীক্ষায় বসেন। কিন্তু আবার ফেল করেন। তিনি আরেকবার নানছুয়াং গ্রামের সেই বাড়িতে যান। এবার দেখেন বাড়ির ফটক বন্ধ। কেউ কোথাও নেই। শুধু পিচ গাছটা দাঁড়িয়ে আছে অনেক ফুল নিয়ে।

সুই হু এত দুঃখ পান যে তিনি একটি কষ্টের কবিতা লিখে কবিতাটি ওই বাড়ির দেয়ালে রেখে আসেন। এর কিছুদিন পরে সুই হু সেই বাড়িতে আবার আসেন। এবার গৃহকর্তার সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি হলেন সেই সুন্দরী কন্যার পিতা। গৃহকর্তা কাঁদতে কাঁদতে বলেন তারা আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে কবিতাটি দেখে সে ভীষণ কষ্ট পায়। সে মনে করে সুই হু আর কখনও ফিরবেন না। তাই তার কন্যা শোকে ও হতাশায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। এইমাত্র মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে।

সুই হু একথা শুনে দ্রুত ঘরে ঢুকে মৃত প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে তীব্র স্বরে কাঁদতে থাকেন এবং বলেন, চোখ খোলো, দেখো আমি সুই হু, আমি ফিরে এসেছি।

সুই হুর বেদনা স্বর্গেও আলোড়ন তোলে। এরপর একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে। মৃত মেয়েটি জীবন ফিরে পায়। সে চোখ মেলে তাকায় এবং সুই হুকে দেখে তার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফোটে।

এ গল্প চীনা সাহিত্যের ইতিহাসে খুব বিখ্যাত। এখানে বলা হয়েছে সত্যিকারের ভালোবাসা সবসময় জয়ী হয়।

চলুন কবিতাটি শোনা যাক

রাজধানীর দক্ষিণে এক গ্রামে

কবি: সুই হু

গেল বছরের এই দিনে এই বাড়িতে এসেছিলাম আমি

এক গোলাপবর্ণ সুন্দরী এবং গোলাপি পিচফুল ফুটেছিল পাশাপাশি

আজ আমি জানি না, হায় সেই সুন্দর মুখ হারালো কোথায়

বসন্ত বাতাসে আজও তো দোলে প্রস্ফুটিত গোলাপি পিচ ফুল।

প্রতিবেদন ও কবিতা অনুবাদ: শান্তা মারিয়া।

 

 

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ।

সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী।