‘চলতি বাণিজ্য’
2023-01-20 21:48:27

চলতি বাণিজ্যের প্রথম পর্বে যা থাকছে:

১. বিশ্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতির কেন্দ্র হয়ে থাকবে চীন

২. ২০২৩ সালে চীনে পুরনো গাড়ি বেচাকেনা ২০ মিলিয়ন ছাড়াবে

৩. মুলধন সংগ্রহ করতে ‘পান্ডা বন্ড’ ছেড়েছে জার্মানির ডয়েচ ব্যাংক

৪. চীনের বাজার ধরতে নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিলো কোকাকোলা

 

 

বিশ্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতির কেন্দ্র হয়ে থাকবে চীন

সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: চলতি বছর পুরোটা সময় জুড়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতির গুরুত্বপূণ কেন্দ্র হয়ে থাকবে চীন। চীনের বিপুল পণ্য উৎপাদন ক্ষমতা প্রভাবিত করতে বিশ্বের প্রতিটি খাতকে। সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন চায়নার প্রেসিডেন্ট মাইকেল হার্ট। তিনি আরো বলেন, কেবল ব্যবসা-বাণিজ্য নয় বরং চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কও প্রভাবিত হবে চীনের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে। এদিকে, ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস পলিসি ফর মেয়র অব লন্ডনের সাবেক পরিচালক জন রস এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ২০২৩ সালে চীনের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের চালিকা শক্তি হবে অভ্যন্তরীণ খাতের প্রবৃদ্ধি।

   

                                         

পণ্য উৎপাদনের এই শব্দই বলে দেয়, আপনি শুনছেন বিশাল এক কারখানায়। বিশ্বের অন্য কোথাও নয়, এই কারখানার অবস্থান বিশাল আয়তনের চীনে। এসব কারখানা আর এর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যক। এই দুটি উপাদানই বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণ। বিশেষ করে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের পণ্য উৎপাদনকারী কলকারখানা এবং চীনের বাজার এখন বিশ্ব অর্থনীতির চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কের নানা দিন নিয়ে গভীর দৃষ্টি রাখেন যারা তাদেরই একজন অ্যামেরিকান চেম্বার ইন চায়না’র প্রেসিডেন্ট মাইকেল হার্ট। এক স্বাক্ষাৎকারে সারা বিশ্বের জন্যই চীনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্‌ঠান, কল কারখানা এবং চীনের ভোক্তা বাজার গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে চীনের অর্থনীতি।

মাইকেল হার্ট, প্রেসিডেন্ট, অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন চায়না

“চীন আবারো উন্মুক্ত হয়েছে, এটা একটা ভালো খবর। ২০২২ সালে এটাই আমাদের অন্যতম প্রধান সুপারিশ ছিলো। মানুষ চীন সফর করতে চায়। কিন্তু আমরা কতোটা সহজে এখানে আসতে পারি? আমরা কোয়ারেন্টিন কতোটা কমাতে পারি? আমরা ক্রমাগত শুনছি, চীন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এতো বিপুল পরিসরে উৎপাদন করার মতো আর একটাও দেশ নেই এই বিশ্বে। চীনের মতো এতো উন্নত পণ্য উৎপাদন আর কেউ পারে না, এতো সরবরাহ আর কেউ করতে পারে না। কাজেই সব খাতেই উৎপাদনের জন্য চীন খুব গুরুত্বপূর্ণ বাজার হয়ে থাকবে এবং আমরাও বিভিন্ন খাতের এসব কোম্পানির সঙ্গে বছরজুড়ে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকবো।“

টানা কয়েক বছর কোভিড-১৯ প্রতিরোধে আরোপ করা বিধিনিষেধ শিথিল করায় এখন খুলতে শুরু করেছে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা। আরো উন্মুক্ত হচ্ছে বাজার। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পণ্যের উৎপাদন।

আগের দশকগুলোতে চীন প্রচুর পণ্য উৎপাদন করতো এবং রফতানি করতো উল্লেখ করে মাইকেল হার্ট বলেন, এখন চীন বিপুল সংখ্যক পণ্য আমদানিও করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি পণ্য থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য চীন আমদানি করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি পণ্যের একটি বড় বাজার হবে যুক্তরাষ্ট্র। এই মার্কিন ব্যবসায়ী নেতা বলছেন, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক।

 

“পুরো বিশ্বেই চীন-মার্কিন সম্পর্কের গুরুত্ব অনেক। আমাদের চিন্তার জায়গা থেকে অবশ্যই একটা মৌলিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ হলো ব্যবসা। কাজেই চীন-মার্কিন সহযোগিতার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে ব্যবসা, ভবিষ্যতেও থাকবে। ২০২২ সালের শেষে রাজনৈতিক বিষয়ের বাইরেও বাণিজ্যিকখাতে একটা ভালো উন্নতি দেখা যায়। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইন্দোনেশিয়ার বালিতে যে বৈঠক করেছেন, এটা বেশ ইতিবাচক বিষয়। আমার মনে হয় এই সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে আমাদের এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।“

অর্থনীতির একজন পেশাদার বিশ্লেষক ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস পলিসি ফর মেয়র অব লন্ডনের সাবেক পরিচালক জন রস। এক সাক্ষাৎকারে বলেন, চলতি ২০২৩ সালে চীনের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে অভ্যন্তরীণ খাতের প্রবৃদ্ধি। তার পরামর্শ, দীর্ঘ মেয়াদী সুফল পেতে হলে চীনের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

জন রস, সাবেক পরিচালক, ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস পলিসি ফর মেয়র অব লন্ডন

“স্বল্প মেয়াদে অবশ্যই গ্রাহকদের জন্য প্রণোদনা দিতে হবে। কারণ কোভিড মহামারির কারণে মানুষ বাইরে বের হওয়া কমিয়ে দিয়েছে, কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে, ভ্রমণ করা কমিয়েছে। ব্যাখ্যা করে বললে, খুচরা পণ্যের বিক্রি গেল বছর নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাপকহারে কম ছিলো। তবে নীতি সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব। অনেক ভালো ভালো ব্যবস্থা নেওয়া যায়, যেমন কর কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে, ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেওয়া যায়, নাগরিকদের আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া যায়। তবে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য সরকারি অবকাঠামো নির্মাণের চেয়ে বরং বেসরকারিখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আর তখনই অথনীতি রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধি থেকে অভ্যন্তরীণ প্রবৃদ্ধি নির্ভর হবে।“

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় অর্থনীতির দেশগুলোর অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সংকোচনশীল মূদ্রানীতি এবং ধীরগতির অর্থনীতির কারণে এ বছরও চীনা পণ্যের চাহিদা কম থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর ফলে চীনের রফতানি কিছুটা কমে যেতে পারে। অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে অভ্যন্তরীণভাবে পণ্যের চাহিদা বাড়াতে হবে এবং গ্রাহকদের নানা রকম প্রণোদনা দেওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

২০২৩ সালে চীনে পুরনো গাড়ি বেচাকেনা ২০ মিলিয়ন ছাড়াবে

চলতি বছর চীনে পুরনো গাড়ির বাজার চাঙ্গা করতে চলতি বছর জানুয়ারি মাসে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় চীন সরকার। এর মধ্যে আছে পুরনো গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা। পাশাপাশি অনুমোদন করা হয় নির্দিষ্ট প্রদেশের ভেতরে গাড়ির মালিকানা বদলকে বৈধতা দেওয়া, হস্তান্তর সহজ করা এবং মালিকানা বদলের ফি বাদ দেওয়া। একইসঙ্গে চলতি বছর থেকেই ব্যক্তিমালাকানায় থাকা গাড়ির বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহারকেও অনুমোদন দেয় চীন।

এসব পদক্ষেপের কারণে চীনে ব্যবহৃত পুরনো গাড়ির বাজার চলতি বছর বেশ চাঙ্গা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এরইমধ্যে চীনের রাজধানী বেইজিংসহ পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ ঝেচিয়াংয়ের ইয়ু শহরে পুরনো গাড়ির বাজারে বেশ চাঙ্গাভাব লক্ষ্য করা গেছে। চীনের গাড়ি বিক্রয়কারী ডিলারদের সংস্থা –চায়না অটোমোবাইল ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ২০২২ সালে পুরনো গাড়ি বিক্রির পরিমাণ কমে গিয়েছিল। সে বছর চীনে পুরনো গাড়ি বি্ক্রি হয় ১৬ মিলিয়নের কিছু বেশি। তবে চলতি বছর পুরোটা সময়জুড়ে গাড়ি বিক্রির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে জানায় সংস্থাটি। 

চায়না অটোমোবাইল ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের সহকারী সাধারণ সম্পাদক জানান, গাড়ির বাজার চাঙ্গা করতে সরকারের নেওয়া সব ধরনের নীতি এবার প্রয়োগ করা হবে। তাদের প্রত্যাশা, চলতি বছর পুরনো গাড়ি বেচাকেনার সংখ্যা ২০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।

 

ভিনদেশে চীন:

মুলধন সংগ্রহ করতে ‘পান্ডা বন্ড’ ছেড়েছে জার্মানির ডয়েচ ব্যাংক

মুলধন সংগ্রহ করতে পান্ডা নামের একটি বন্ড ছেড়েছে জার্মানির ডয়েচ ব্যাংক। তাদের পরিকল্পনা এই বন্ডের মাধ্যমে আগামী ৩ বছরের মধ্যে অন্তত ১ বিলিয়ন ইউয়ান সমমূল্যের তহবিল সংগ্রহ করা।

সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে এই ‘পান্ডা বন্ড’ চালু করে ডয়েচ বন্ড। এই বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে চীনের অফশোর বন্ড মার্কেটে সরাসরি প্রবেশ করতে পারবে ব্যাংটি। আকর্ষণ করা যাবে চীনা বিনিয়োগ। এরইমধ্যে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক অব চায়না’ এবং চীনের স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব ফরেন এক্সচেইঞ্জ এই বন্ড অনুমোদন করেছে।

 

কোম্পানি প্রোফাইল:

চীনের বাজার ধরতে নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিলো কোকাকোলা

কোম্পানি প্রোফাইলে বিশ্বের খ্যাতনামা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও তাদের কর্তাব্যক্তিদের নানা সফলতার গল্প তুলে ধরি। চলতি বাণিজ্যের এবারের পর্বে থাকছে কোমলপানীয় উৎপাদনকারী জায়ান্ট কোম্পানি কোকাকোলার কার্যক্রমের খবর। সম্প্রতি চীন ও মঙ্গোলিয়ার বাজার ধরতে সেই অঞ্চলের জন্য নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিয়েছে কোকাকোলা।

চীন ও মঙ্গোলিয়ার বাজার ধরতে ওই অঞ্চলের জন্য কোম্পানির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে কোমলপানীয় জায়ান্ট কোম্পানি কোকাকোলা। ফ্রান্সের নাগরিক গিলেস ল্যাকলার্ককে এ পদের জন্য মনোনয়ন দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

চীনা বাজার কোমলপানীয় প্রস্তুতকারক কোকাকোলার একটি প্রধান বাজার হয়ে উঠেছে বহু আগে থেকেই। এবার সেই বাজারে আধিপত্য বিস্তারের পালা। ফলে চীন ও মঙ্গোলিয়ার মতো বিশাল আকারের দেশের জন্য নতুন করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলো স্বতন্ত্র ব্যক্তিতে।

গিলেস ল্যাকলার্ক

২০২০ সালে হাতে প্রথম কৌশলগত রূপান্তর কার্যক্রম হাতে নেয় কোকাকোলা। এর্ই অংশ হিসেবে চীন ও মঙ্গোলিয়ার বিশাল বাজারের জন্য একজন করে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেওয়া শুরু করে এই কোম্পানিটি। গিলেস লেকলার্কের আগে এই দায়িত্ব পালন করেন ভামসি মোহাস থাতি।

বছর দ্য কোকোকোলা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেমস কুইনসি বলেন, চীনে কোকাকোলার বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি বেশ ভালো। তবে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে চীনের কোন কোন প্রদেশে ব্যবসা কমে যায়। তাই নতুন প্রেসিডেন্টের হাতে ব্যবসা ধরার অনেক সুযোগ এখনো আছে।

চীন ও মঙ্গোলিয়া অঞ্চলের প্রেসেডেন্ট হওয়ার আগে ‘দ্য ম্যাগডোনাল্ডস ডিভিশন’ এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন গিলেস লেকলার্ক। দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বের অন্তত ১০০টি মার্কেট ও ৩৮ হাজার রেস্টুরেন্টে কোকাকোলার পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করেন। এর পাশাপাশি কোম্পানির কৌশলগত নির্দেশনা ও প্রধান প্রধান বাণিজ্য এলাকায় সেসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্বও পালন করেন।

চীনের বাজার ধরতে বহুজাতিক এই কোম্পানিটি নিয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ। যেমন কোকাকোলার বোতলের মান নিশ্চিত করতে বাছাই করা হয়েছে খ্যাতিমান পার্টনার। আবার কোভিড-১৯ মোকাবিলা করে বাজার ধরে রাখতেও ছিলো কিছু কার্যক্রম।

১৯৯৮ সালের প্রথম কোকাকোলা কোম্পানিতে যোগ দেন গিলেস লেকলার্ক। কোম্পানির হয়ে দায়িত্ব পালন করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স ও সিঙ্গাপুরে। পেশাগত জীবন শুরুর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব হার্টফোর্ডের বার্নি স্কুল অব বিজনেস থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

প্রতিবেদন: সাজিদ রাজু