চীনের ইয়ুননান প্রদেশের পাহাড়াঞ্চলের শিক্ষার্থী লি মিং মায়ের আত্মউন্নয়নের গল্প
2023-01-16 14:57:58

নতুন বছরে চলে এসেছে। নতুন বছরে আপনাদের নতুন কোনো প্রত্যাশা বা পরিকল্পনা আছে? গত বছরের শেষ দিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম জাতীয় কংগ্রেস আয়োজিত হয়। এ সম্মেলনের পর প্রকাশিত প্রতিবেদনে চীনা জাতির পুনরুত্থান ও চীনা সমাজের আধুনিকায়ন বাস্তবায়নে বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা পেশ করা হয়। চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংও বার বার বলেন যে, যুবসমাজ হচ্ছে দেশের উন্নয়নের স্তম্ভ ও ভিত্তি। তাই চীনা যুবক-যুবতীদের আত্মউন্নয়ন চীনা বৈশিষ্ট্যময় আধুনিকায়নের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মাধ্যমে চীনা যুবসমাজের চেতনা ও চিন্তাধারা প্রতিফলিত হয়। প্রত্যেক যুবক-যুবতী সাধারণ মানুষ, তারা আমাদের আশেপাশে বসবাস করে এবং জীবন  কাটায়। তাদের যৌথ প্রয়াস ও আত্মউন্নয়ন চীনা জাতির পুনরুত্থানের স্বপ্ন পূরণে আমাদের আশাবাদী করে।

    আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের ইয়ুননান প্রদেশের পাহাড়াঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী ছেলে লি মিং মায়ের গল্প তুলে ধরবো। তার জীবন অনেক কষ্টকর ছিল। তবে, তিনি কষ্টকে মোকাবিলা করে আত্মউন্নয়নের মাধ্যমে সুখী জীবন অর্জন করেছেন। আসুন, তাঁর গল্প শুনি।

    ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে চীনের ইয়ুননান প্রদেশের লিনছাং শহরের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ছেলে লি মিং মা। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল ছিল, তাই ছোটবেলা থেকে বাবামায়ের সাথে কৃষিক্ষেতে তাকে কাজ করতে হতো। ছোট বাচ্চারা সবাই মিছরি খেতে পছন্দ করে, তবে ছেলে লি মিং মা’র জন্য মিছরি সহজলভ্য ছিল না। ৫ বছর বয়সে সে পিতামাতার সাথে পাহাড়ে আরোহণ করে চা-পাতা সংগ্রহ করা শুরু করে। প্রতি ঝুড়ি চা-পাতা সংগ্রহ করলে সে ৫ সেন্ট পেতো, যা দিয়ে সে মিছরি কিনতে পারতো। ৫ বছর বয়সের ছেলের জন্য এক ঝুড়ি চা-পাতা অনেক ভারী। একবারে সে তা বহন করতে পারতো না। সে ভাগ করে সেগুলো বহন করে নিয়ে যেতো। সে বাবামায়ের কাছে শিখেছে যে, দরিদ্র হলেও নিজের জীবন সুন্দর করার জন্য আরও পরিশ্রম করতে হবে। তখন থেকে সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে অবশ্যই ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে। প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর অক্ষর লেখা ও গণিত শিখতে শুরু করে সে। একসময় সে তার কাজিনের জন্য চা-পাতার ওজন মাপ করে হিসাব করার কাজ শুরু করে এবং কাজিনের সাথে চা-পাতা কারখানায় পাঠানোর কাজ করতে থাকে। প্রত্যেকবার কারখানায় গেলে তাকে রাত ২টার পর বাসায় ফিরতে হতো। তবে প্রত্যেকবার তার উপার্জন হতো ৫ থেকে ১০ ইউয়ান। এভাবে ছোটবেলা থেকেই কিছু টাকা উপার্জন করা শেখে সে।

    প্রতিদিন ভোর ৫টায় জেগে তাকে স্কুলে যেতে হতো। তবে, এতে সে কখনও কষ্ট বোধ করতো না। প্রাথমিক স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে বড় সাইজের ব্যাগ বহন করে ১২ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে তাকে স্কুলে যেতে হতো। স্কুলের ক্লাসরুমে কোনো হিটিং ব্যবস্থা ছিল না। তাই তাকে বাড়ি থেকে কাঠকয়লার বেসিন নিয়ে যেতে হতো। একটু বড় হওয়ার পর সে সবসময় রাত পর্যন্ত স্কুলের ক্লাসরুমে পড়াশোনা করতে শুরু করে এবং মাঝে মাঝে দেরি হয়ে গেলে শিক্ষকদের অফিসে লেখাপড়া করতো। পাহাড়াঞ্চলের রাস্তা, নদী ও ঠাণ্ডা আবহাওয়া সব বাচ্চার জন্য চ্যালেঞ্জিং। তবে ছেলে লিমিংমা কখনো আপোস করেনি, সে প্রতিদিন পরিশ্রম করেছে, নিয়মিত স্কুলে গেছে। যদিও তার পিতামাতা কখনো শিক্ষা গ্রহণ করেননি, তবে তারা বাচ্চার পড়াশোনায় সমর্থন দেন।

    প্রাথমিক স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর সে মাধ্যমিক বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করতে যায়। যখনই তার মনে পড়াশোনাসংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন জাগতো, সে শিক্ষকদের কাছে প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইত। অনেক বছরের পরিশ্রমের পর অবশেষে সাফল্য পায় লি মিং মা।

    ২০১৫ সালের জুলাই মাসে কাওখাও পরীক্ষার পর চিয়াংসু প্রদেশের রাজধানী নানচিং শহরের সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য একাডেমির শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হয় সে। তার গ্রামের একমাত্র শিক্ষার্থী হিসাবে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পায় সে।

    অতীতের কষ্টকর জীবনের কথা স্মরণ করে লিমিংমা বলল, ‘যখন আমি মাধ্যমিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি, তখন আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আমার মা সে কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিলেন না, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। আমার বাবাও অতিরিক্ত কাজের জন্য অসুস্থ হয়ে যান। আমি তখন ভাবি, যদি আমার পড়াশোনা ভালো হয়, আমি পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে পারবো, আমার মা ফিরে আসবেন এবং বাবার চিকিত্সা হবে।’

    ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তার বাবা আর কাজ করতে পারেননি। তাই বাবার চিকিত্সাখরচ ও পড়াশোনার খরচ সব নিজেকেই বহন করতে হয়। স্কুলের ঋণ ও বৃত্তি ছাড়া সে বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও কারখানায় অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করতে থাকে। সাপ্তাহিক ছুটি বা স্কুলের ছুটিতে একদিনে ১৬ ঘন্টার মতো কাজ করতো লি মিং মা। যদিও জীবন অনেক কষ্টকর, তবে পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি আগের মতো মনোযোগীই ছিলেন। এ সম্পর্কে ছেলে লি বলেন, ‘যদিও আমার জীবন অন্যদের চেয়ে বেশি কষ্টের ছিল, তবে ভালো করে পড়াশোনা করা ছিল আমার স্বপ্ন, সেটি আমার জন্য সুখের ব্যাপার।’

    ২০২০ সালে চমত্কার স্কোর করে মাস্টার্সে ভর্তি হবার যোগ্যতা পান তিনি। তার পিতা অসুস্থতার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। শেষমুহূর্তে বাবা তাকে বলেন, ‘যদিও আমাদের পরিবার দরিদ্র, তবে আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অন্যদের চেয়ে দুর্বল নয়। বাবার কথা স্মরণ করে লি বললেন, ‘আমার সুখী ও স্বাস্থ্যকর জীবন কামনা করতেন বাবা। তাই আমি তাঁর আশা পূরণ করবো। যদি আমাদের বাছাইয়ের সুযোগ থাকতো, তাহলে আমি অবশ্যই কষ্টকর জীবন বেছে নিতাম না। তবে, এখন পিছনের দিকে ফিরে তাকালে সে সংগ্রামী অভিজ্ঞতা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ মনে হয়। আমি প্রতিদিন ব্যস্ততার মধ্যে পড়াশোনা করেছি, সময় নষ্ট করিনি।’

    বর্তমানে লি জন্মস্থানের একটি সামাজিক স্বেচ্ছাসেবককেন্দ্রের কর্মী। প্রতি বছরের শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে জন্মস্থানে ফিরে স্থানীয় বাচ্চাদের ক্লাস নেন এবং প্রবীণদের যত্ন নেন তিনি। ছোটবেলায় নিজেও এমন সাহায্য পেয়েছেন তিনি। এখন বড় হওয়ার পর একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অন্যদের সাহায্য করছেন। এটা তাঁর জীবনের জন বেশ তাত্পর্যপূর্ণ ব্যাপার।

    স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে হয় ধৈর্য ও আন্তরিকতার সাথে। নিজের মাসিক বেতন বেশি নয়, তবে স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের সাহায্য দিতে প্রতিমাসে কিছু টাকা তিনি ঠিকই পাঠিয়ে দেন। ছুটির দিনে বাচ্চাদের পড়াশোনা সংশ্লিষ্ট কিছু টিপস দেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেন। অনেক বাচ্চা তাকে চিঠি লিখে কৃতজ্ঞতা জানায়। এতে তৃপ্ত হয় লি মিং মা।

    অতীতে তিনি অপরিচিত লোকদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে পরিশ্রমের সাথে পড়াশোনার মাধ্যমে একজন চিকিত্সক হয়েছেন। ২০২১ সালে নানচিং শহরের চিকিত্সক প্রতিনিধি হিসেবে  চিয়াংসু প্রদেশের সিডিসি’র মহামারী প্রতিরোধক দলে যুক্ত হন লি মিং মা। তার নেতৃত্বে করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা, জিন সিকোয়েন্সিং এবং সনাক্ত রোগীদের পিসিআর পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন হয়। দেড় মাসের মধ্যে হাজারটি পিসিআর প্রতিবেদন করেছেন তিনি এবং ৪০০টিরও বেশি ভাইরাসের জিন সিকোয়েন্সিং করেছেন। প্রায় একমাসের মধ্যে তার স্বেচ্ছাসেবক কাজের সময় ৪২৯ ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। ২০২২ সালে নতুন দফার করোনাভাইরাস আসার সময় তিনি আগের মতো নানচিং শহরের মহামারী প্রতিরোধে নিজের অবদান রাখেন।

    ২০২১ সালের চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘আত্মউন্নয়ন’ পুরস্কারবিজয়ী হিসেবে নির্বাচিত হন লি মিং মা। ছোটবেলা থেকে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি কষ্টকর জীবন কাটান তিনি, কিন্তু সেই প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি আত্মউন্নয়নে সফল হন। লি মিং মা মনে করেন, দরিদ্রতা কোনো ভয়ঙ্কর ব্যাপার নয়, তবে দরিদ্র পরিবেশে যদি সংগ্রামের চেতনা হারিয়ে যায়, সেটি আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার। গত ৭ বছর ধরে সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাহায্যে কেবল পেশাগত চিকিত্সাজ্ঞান অর্জন করেছেন তিনি তা নয়, বরং আরো অনেককিছু শিখেছেন, জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ব্যস্ততার মধ্যে ম্যাজিক কিউব আর স্কেটবোর্ড খেলতে শিখেছেন তিনি। ২০২৩ সালে সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন তিনি। ভবিষ্যতে আরো বেশি জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের জীবন আরো সুন্দর হয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস করেন লি।

    (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)