চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর ৩৩ বছরের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রথম আফ্রিকা সফরে যাবার পথে ১০ জানুয়ারি মধ্যরাতে ঢাকায় প্রায় দু’ঘন্টার যাত্রাবিরতি করেন ছিন কাং। এ সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তাঁকে বিমান বন্দরে স্বাগত জানান। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত বৈঠকও করেন বিমান বন্দরে। বৈঠকে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও সহযোগিতার বিষয়ে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনা করেন।
চীনের ঐতিহ্য অনুযায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন কাংয়ের প্রথম আফ্রিকা সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। আর বিমানের জ্বালানি নেওয়ার জন্য ঢাকায় তার সংক্ষিপ্ত এ যাত্রা বিরতি- এ কথা বলা হলেও এ জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেওয়াকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন তারা।
চীন-আফ্রিকা সমন্বিত ও কৌশলগত সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব আরো গাঢ় করতে ইথিওপিয়া, গ্যাবোন, অ্যাঙ্গোলা, বেনিন, মিশর সফর করছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ সফরকে আফ্রিকা-চীন সম্পর্ক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা হিসেবে উল্লেখ করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
ইউনিভার্সিটি অব জোহানেসবার্গের সেন্টার ফর আফ্রিকা-চায়না স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক ইমানুয়েল মাতাম্বো ছিন কাংয়ের প্রথম এ আফ্রিকা সফর সম্পর্কে বলেন, তার এ সফরের মাধ্যমে আসছে দিনগুলোতে চীনের সঙ্গে আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোর সম্পর্কের গুরুত্ব আরও বাড়বে।
আফ্রিকা মহাদেশে আরও অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের সহযোগিতা কামনা করে এই বিশ্লেষক বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি প্রতিরোধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা বিষয়ে আফ্রিকার সহযোগী দেশ হিসেবে কাজ করার সুযোগ আছে চীনের।
ইমানুয়েল মাতাম্বো বলেন, ছিন কাংয়ের প্রথম আফ্রিকা সফর কেবল একটি পুরনো রীতিই নয় বরং বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং আফ্রিকার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক রক্ষার প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে চীন যে আন্তরিক এটি তার সাক্ষ্য বহন করে। ২০২৩ সালে চীন-আফ্রিকা সম্পর্কের ব্যাপারে উচ্চ আশাবাদ ব্যক্ত করে মাতাম্বো।
আফ্রিকা সফরে থাকা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন কাংও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন, আফ্রিকার আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি বড় মঞ্চ হওয়া উচিত। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, আফ্রিকার শান্তি ও উন্নয়ন ছাড়া বিশ্বের স্থিতিশিলতা ও সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। আফ্রিকা ঐক্য ও সহযোগিতা চায়, সংঘাত চায় না। আফ্রিকা বড় দেশগুলোর রাজনৈতিক খেলার জায়গা নয় বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ছিন কাং আরও বলেন, চীন ও আফ্রিকার মধ্যে গভীর ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্ব রয়েছে। নতুন শতাব্দিতে চীন আফ্রিকায় একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এ সব প্রকল্পের সুফল আফ্রিকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রতিফলিত হয়েছে। আফ্রিকা ও আফ্রিকার জনগণ এ জন্য চীনের প্রশংসা করে।
এদিকে, আফ্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ সফরে যাবার পথে যাত্রাবিরতির জন্য ছিন কাংয়ের বাংলাদেশকে বেছে নেওয়াকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন বিশ্লেষণে তারা বলছেন, চীন যে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুপ্রতীম ও উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র মনে করে ছিন কাংয়ের ঢাকায় যাত্রাবিরতি তারই প্রমাণ।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক মুন্সী ফয়েজ আহমেদ মনে করেন, বাংলাদেশকে চীন গুরুত্ব দেয় বলেই ছিন কাং যাত্রাবিরতির জন্য ঢাকাকে বেছে নিয়েছেন। না হলে তিনি অন্য কোনো দেশেও যাত্রাবিরতি করতে পারতেন।
ঢাকায় যাত্রাবিরতির ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার যে একটা অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হতে পারে সেটা নিশ্চয় চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাবনায় বলেও মনে করেন মুন্সী ফয়েজ।
চীনকে বাংলাদেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগীকে হিসেবে উল্লেখ করে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে চীনের নানা উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে নিতে সব ধরনের সুযোগ কাজে লাগানো উচিত আর ছিন কাং সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিন কাংয়ের সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতির সুযোগটিকে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি চীনের বাজারে ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত কোটা সুবিধা কার্যকরের উদ্যোগ নিতে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময়ে সই করা অর্থ সহায়তা বিষয়ক কয়েকটি চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়েও ছিন কাংয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানান আবদুল মোমেন।
একচীন নীতিতে বাংলাদেশের দৃঢ় সমর্থন এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক যে কোনো ইস্যুতে বাংলাদেশ চীনকে সমর্থন দিয়ে যাবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন কাংকে আশ্বস্ত করেন আব্দুল মোমেন।
বিমান বন্দরে তাদের এ অনানুষ্ঠানিক বৈঠক ও আলোচনাকে আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরস্পরকে নিজ নিজ দেশে নিমন্ত্রণ করেন। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরস্পরের নিমন্ত্রণ গ্রহণও করেছেন বলে এ কে আবদুল মোমেন জানান।
সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ আফ্রিকা সফরে যাবার পথে বাংলাদেশে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতিটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।