জানুয়ারি ১৩: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলির জন্য তার ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে, তবে তার পদক্ষেপগুলি তার বিবৃতির সঙ্গে বেমানান। কিছুদিন আগে, ১০০টিরও বেশি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সুরক্ষা এবং অন্যান্য সংস্থা মার্কিন সরকারকে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ১৯৪০-এর দশকে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে বড় আকারের পারমাণবিক পরীক্ষার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া এবং যুক্তিসঙ্গত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ করার দাবি জানায়। এটি আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে ন্যায়সঙ্গত আহ্বান। পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারে জড়িত যুক্তরাষ্ট্র জনসাধারণের সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ ১২০০টিরও বেশি বড়-ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ ১৯৪৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে ছিল। এই অঞ্চল ১৯৮৬ সালে স্বাধীন হয়। ২০১৯ সালে লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত, যুক্তরাষ্ট্র মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে ৬৭টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল। বিশেষ করে ১৯৫৪ সালের ১ মার্চ, মার্কিন সামরিক বাহিনী মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের বিকিনি অ্যাটলে সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্রগুলির একটি, "ক্যাসল ব্রাভো" হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। বিধ্বংসী শক্তি জাপানের হিরোশিমায় ফেলা ১ হাজার পারমাণবিক বোমার সমান! পারমাণবিক পরীক্ষায় বেঁচে যাওয়া নেরজে জোসেফ বলেন যে, তিনি ও তার আশেপাশের লোকজন ত্বক পোড়া এবং চুল পড়ায় ভুগছিলেন এবং অনেক লোক থাইরয়েড ক্যান্সার ও অন্যান্য গুরুতর রোগেও ভুগছিলেন। এ ছাড়া, সেখানকার পরিবেশের অপূরণীয়ভাবে ক্ষতি হয়েছে। বিপুল সংখ্যক মাছ মারা গেছে, প্রবাল বিবর্ণ হয়ে গেছে। অনেক বাসিন্দাকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
এই সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেভাদা পারমাণবিক পরীক্ষার সাইট থেকে সরাসরি মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে ১৩০টন পারমাণবিক দূষিত মাটি ফেলে দিয়েছে। আজ, এখানকার পারমাণবিক বর্জ্য ল্যান্ডফিলকে স্থানীয় বাসিন্দারা ‘কবর’ বলে থাকেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যখন ২০১৯ সালে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলি সফর করেছিলেন, তখন তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন যে, পারমাণবিক দূষণ সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ ১৯৮৬ সালে ‘ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি’তে স্বাক্ষর করে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয়। সেই সময়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিল। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সালিসি ট্রাইব্যুনাল রায় দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের ২.৩ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা প্রত্যাখ্যান করে। লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসের উদ্ধৃত নথিগুলি দেখায় যে, যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ৪ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আর্কাইভস ওয়েবসাইটে ২০০৫ সালের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ও মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে ১৯৮৬ সালের চুক্তিতে পারমাণবিক ক্ষতিপূরণ ‘অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব দাবিগুলি’ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার মানে তারা আর কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে চায় না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনৈতিক ও আধিপত্যবাদী কর্মকাণ্ড বিশ্বজুড়ে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। ২০২২ সালে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫১তম অধিবেশন একটি প্রস্তাব পাস করে- যা সংশ্লিষ্ট দেশগুলির অনুরূপ দায়িত্ব গ্রহণের জন্য এবং পারমাণবিক পরীক্ষার ক্ষতিগ্রস্তদের সমাধানে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জকে সহায়তা করার আহ্বান জানায়।
২০২২ সাল থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলির বিরুদ্ধে একটি গভীর কূটনৈতিক আক্রমণ শুরু করে। প্রথম মার্কিন-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলির শীর্ষসম্মেলন সম্প্রতি ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ অঞ্চলে উন্নয়নে সহায়তা করতে চায়, তবে প্রথমে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলির আস্থা অর্জন করা উচিত।
উপরন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক সমাজের উদ্বেগের প্রতি সাড়া দিতে হবে এবং অবিলম্বে বিশ্বজুড়ে তার পারমাণবিক বিস্তারের বিপজ্জনক আচরণ বন্ধ করতে হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক পারমাণবিক বিস্তারের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে পারমাণবিক সাবমেরিন সহযোগিতায় জড়িত হওয়ার জন্য "অকাস" প্রতিষ্ঠা করা থেকে শুরু করে এশিয়ায় "পারমাণবিক ভাগাভাগি" মডেলের প্রতিলিপি করার চেষ্টা করেছে।
পারমাণবিক অস্ত্র হল মানুষের মাথার উপর ঝুলন্ত "ড্যামোকলের তলোয়ার"। সবচেয়ে বড় পারমাণবিক অস্ত্রের দেশ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের শুধু মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের পারমাণবিক পরীক্ষার ক্ষতিপূরণই নয়; বরং,বিপজ্জনক পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের আচরণ বন্ধ করা উচিত।
(ইয়াং/তৌহিদ/ছাই)