আধা শতাব্দির আগে যে সফরে জন্ম হয় চীন-ফিলিফিন্স বিরল মৈত্রী
2023-01-13 13:52:45

আজকের অনুষ্ঠান আমরা কথা বলবো নতুন বছরের শুরুতে চীনে প্রথম সফরে এসেছেন একজন বিদেশী শীর্ষনেতার গল্প।

নতুন বছরের শুরুতে চীনে প্রথম সফরে এসেছেন একজন বিদেশী শীর্ষনেতা। তিনি হলেন ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এটি তাঁর প্রথম চীন সফর এবং আসিয়ানের বাইরে প্রথম বিদেশ সফর। তাতে চীন-ফিলিপিন্স সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা এবং দ্বিপাক্ষিক কূটনীতিতে একে অপরের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের প্রতিফলন হয়েছে।

ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রের সঙ্গে বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেন, আটচল্লিশ বছর আগে প্রেসিডেন্ট মার্কোসের বাবা চীনের প্রবীণ নেতাদের পথ অনুসরণ করে চীন-ফিলিপিন্স কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন,  সে ঐতিহাসিক সুন্দর গল্প এখনও চীনাদের মুখে মুখে প্রচলিত।

এ বিরল মৈত্রী আধা শতাব্দী আগের একটি সফরে জন্ম হয়। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই’র আমন্ত্রণে ফিলিপিন্সের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস সিনিয়রের স্ত্রী ইমেল্দা মার্কোস ১৭ বছর বয়সী ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রকে (বর্তমান প্রেসিডেন্ট) নিয়ে চীন সফর করেন। বেইজিং ক্যাপিটাল বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর প্রেসিডেন্ট দম্পতির চোখে পড়ে সারি সারি দু’দেশের জাতীয় পতাকা। ফিলিপিন্সের ফাস্ট লেডি ইমেল্দা মার্কোস পরে কোনো একসময় বলেছেন,  ‘আমরা যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই হাজার হাজার মানুষ আমাদের সংবর্ধনা জানিয়েছে।’

ইমেল্দা মার্কোস চীনের থিয়ান চিন,  হাং চৌ ও শাংহাই সফর করেন। মার্কোস জুনিয়র মায়ের সঙ্গে অনেক স্থানে উপস্থিত ছিলেন। ফিলিপিন্সের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে ইমেল্দা চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং’র সঙ্গে সাক্ষাত্ করার প্রত্যাশা করেন। তবে, মাও সেতুং সে সময় হু নান প্রদেশে ছিলেন এবং তাঁদের সাথে দেখা করতে পারতেন না। এ কথা শুনে হতাশ হন ইমেল্দা। তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগকে চেষ্টা করার অনুরোধ জানান। অনেক সমন্বয় ও চেষ্টার ফলে ইমেল্দা ও তাঁর সঙ্গী প্রত্যাশা পূরণে ছাং শা শহরে সফর করেন।

উল্লেখ্য, ইমেল্দার ভাগ্য চীনের সঙ্গে জড়িত আছে। তাঁর মায়ের দাদা হু নান প্রদেশের আধিবাসী ছিলেন। তাই তাঁর সঙ্গে দেখার সময় চেয়ারম্যান মাও সেতুং বলেন,  ‘আমরা একই হোমটাউনের অধিবাসী। একই হু নান প্রদেশ থেকে এসেছি।’ চেয়ারম্যান মাও’র একথায় মুগ্ধ হয়ে ইমেল্দা চীনা ভাষায় ‘আমি বেইজিংয়ের থিয়ান আন মেনকে ভালোবাসি’  শীর্ষক গান গাইতে শুরু করেন। তাঁর গাওয়া গান শুনে মাও সেতুং খুব আনন্দিত হন। তিনি করতালি দিয়ে ইমেল্দার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

এ সাক্ষাতে চেয়ারম্যান মাও ইমেল্দার হাতে চুমু খান। যা বিখ্যাত ও সুন্দর একটি মুহূর্তের সৃষ্টি করেছে। একমাত্র ইমেল্দার হাতেই মাও সেতুং চুমু খেয়েছেন। সে সময় মার্কোস জুনিয়র আনন্দের সঙ্গে চেয়ারম্যান মাও’র কাছে গিয়ে তাঁর বাম ও ডান গালে কিস করেন। তিনজনের ছবিতে মার্কোস জুনিয়র চেয়ারম্যান মাও’র ডান পাশে অত্যন্ত কাছে দাঁড়িয়েছেন।

সে সময় চীন ও ফিলিপিন্সের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়নি। ইমেল্দা’র চীন সফর চীন-ফিলিপিন্স সম্পর্কের বরফ গলাতে শুরু করে।

১৯৭৫ সালের জুন মাসে মার্কোস জুনিয়রের বাবা তত্কালীন প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস সিনিয়র তাঁর স্ত্রী ইমেল্দাকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চীন সফর করেন। চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং মার্কোস সিনিয়ের সঙ্গে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বৈঠক করেন। এটি বয়স্ক মাও সেতুং’র বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে সবচেয়ে দীর্ঘ বৈঠক। এরপর চৌ এন লাই মার্কোস সিনিয়রের সঙ্গে অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক বিষয় এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে মতবিনিময় করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে দু’দেশের ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন,  যা দু’দেশের মৈত্রীর নতুন সূচনা করে। মার্কোস সিনিয়র কবিতার ভাষায় বলেন,  ‘চীনগামী সেতু আবার গঠিত হয়েছে’।

এরপর থেকে সকল আন্তর্জাতিক ও ফিলিপিন্সের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে মার্কোস ও তাঁর পরিবার  চীন-ফিলিপিন্স মৈত্রীকে প্রমোট করেছেন। পরিবারের প্রভাবে মার্কোস জুনিয়র বরাবরই দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছেন।

১৯৮৩ সালে তিনি তরুণ কর্মকর্তাদের নিয়ে ১০ দিনের চীন সফরে আসেন। পরে তিনি ও তাঁর পরিবার বেশ কয়েকবার চীন সফর করেন। মাও সেতুং যে তরুণের সঙ্গে দেখা করেছেন, সে তরুণ এখন ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট মার্কোস জুনিয়র তাঁর বাবার স্থাপিত সম্পর্কের ভিত্তিতে দু’দেশের সম্পর্ককে আরও উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

২০২৩ সালের শুরুতে চীন সফরের আগে মার্কোস জুনিয়র ফিলিপিন্সে একটি প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন,  কয়েক ডজন বছর আগে একজন তরুণ হিসেবে আমি চীন সফর করেছিলাম। সে সফর ফিলিপিন্সের কূটনীতিতে একটি মাইলফলক ছিল। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং’র সঙ্গে বৈঠকের সময় তিনি আবার সে সফরের কথা স্মরণ করে বলেন,  ফিলিপিন্স-চীন কূটনৈতি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ইতিহাস মাত্র ৪৮ বছর হওয়া সত্ত্বেও দু’দেশের জনগণের মৈত্রী হাজার বছরের পুরোনো। আমি ভাগ্যবান যে  ফিলিপিন্স-চীন কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আজ থেকে আমি দু’দেশের ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী ধারণ ও সম্প্রসারণের দায়িত্ব পালন করে যাবো।

ফিলিপিন্সে একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে: আসার পথ না চিনলে দূরদূরান্তে যাওয়া যাবে না। চীন ও ফিলিপিন্সে সামাজিক ব্যবস্থা ভিন্ন হলেও দু’দেশের আছে উন্নয়নের পথে একই লক্ষ্য। দু’দেশের মধ্যে রয়েছে সহযোগিতার ব্যাপক সম্ভাবনা।

সফরকালে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’, কৃষি ও মত্স্য,  অবকাঠামো,  ব্যাংকিং,  শুল্ক,  ই-কমার্স ও পর্যটনসহ নানা সহযোগিতা দলিল স্বাক্ষর প্রত্যক্ষ করেছেন দুদেশের শীর্ষনেতাগণ। দু’নেতা একমত হন যে  নতুন পরিস্থিতিতে চীন ও ফিলিপিন্স সার্বিক কৌশলগত সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করবে,  একে অপরের সহযোগী ও সুপ্রতিবেশী হবে এবং পারস্পরিক কল্যাণ সৃষ্টিকারী সু-অংশীদার হবে।

(রুবি/এনাম)