চীনের চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উন্নয়নের ইতিহাস
2023-01-09 15:40:07

প্রত্নতত্ত্ব মেজর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, দেশে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটের সন্ধানলাভের পর, প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মীদের অনুসন্ধানকাজ মিডিয়ার মাধ্যমে দর্শকদের সামনে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপিত হতে থাকলে, এই মেজরের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়তে থাকে।

    প্রাচীনকালের শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও ধ্বংসাবশেষ প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মীদের প্রচেষ্টায় নতুন করে সবার সামনে আসে, যা সাধারণ মানুষের জন্য বেশ আকর্ষণীয় ব্যাপার। আজকের অনুষ্ঠানে চীনের চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উন্নয়নের ইতিহাস তুলে ধরবো।

    চলতি বছর চীনের চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ স্থাপনের সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হচ্ছে। গত ৫০ বছরে এ বিভাগ থেকে ৩০০০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী স্নাতক হয়েছেন, যারা চীনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতত্ত্ব প্রকল্পে অংশ নিয়েছেন। যেমন, চীনের তিন গিরিখাত প্রকল্প, দক্ষিণাঞ্চলের জল উত্তর চীনে স্থানান্তর করা, ইত্যাদি। এখন চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ চীনে সুবিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ব কর্মীদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

    ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত, চীনের ইয়াংসি নদীর তিন গিরিখাত প্রকল্পের পানিতে ডুবে যাওয়া এলাকায় স্থানীয় পুরাকীর্তির সংরক্ষণকাজ চলে। চীনের বিভিন্ন এলাকা থেকে মোট ৬৪টি প্রত্নতত্ত্বদল তিন গিরিখাতে যায়, যাদের মধ্যে অর্ধেক দলের প্রধানগণ চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের স্নাতক শিক্ষার্থী।

    ১৯৭৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ২৩ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ওয়াং ওয়ে অধ্যাপক চাং চং ফেইয়ের ক্লাসে প্রত্নতত্ত্ব গবেষণাবিষয়ক প্রশ্ন করেন। বর্তমানে তিনি চীনা সভ্যতার উত্স অনুসন্ধান-প্রকল্পের শীর্ষ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। যখন তিনি চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যাপক চাং চং ফেই কঠোর ও গম্ভীর মনোভাব নিয়ে এ গবেষণাকাজ করছিলেন। তিনি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাস্তব দিক থেকে প্রশ্ন করার জন্য বলতেন। তাঁর ক্লাসে বই না-পড়ে, ফিল্ডে না-গিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ পাওয়া যেতো না। অধ্যাপকের গভীর প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর।  প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীদের স্মৃতিতে গভীর দাগ কেটেছেন তিনি। যদিও এখন তাদের সবার বয়স ৫০, কিন্তু তারা অধ্যাপক চাংয়ের সাথে দেখা করতে গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন।

    অধ্যাপক চাংয়ের কঠোর মানদন্ডের কারণে চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার স্টাইল ছিল ভিন্ন, তাদেরকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হতো। ১৯৭২ সালে চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মাত্র গঠিত হয়েছে, তখন ৭টি কোর্সে মাত্র দু’জন শিক্ষক ছিলেন। সেই সময় শিক্ষকের অভাব মেটাতে শিক্ষার্থীদের দ্রুত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন অধ্যাপক চাং চং ফেইসহ সিনিয়র শিক্ষকরা। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের বেছে নিয়ে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমি ও পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়, যাতে তাঁরা আরও বেশি জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং ফিরে এসে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়।

    প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক গবেষণায় ফিল্ড জরিপ অতি গুরুত্বপূর্ণ। গত ৫০ বছরে চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গবেষণা কোর্স অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে, তবে ফিল্ড জরিপের কাজ কখনো পরিবর্তন হয়নি। শিক্ষার্থীরা মাঠে কাজ করেন এবং নিজেদের অবস্থা এভাবে বর্ণনা করেন: ‘দূর থেকে দেখলে শরণার্থীদের মতো, কাছে গিয়ে দেখলে ভিক্ষুকদের মতো। আসলে, এরা প্রত্নতত্ত্বের ফিল্ড জরিপে ব্যস্ত শিক্ষার্থী!’ এ কথা থেকে বোঝা যায় যে, প্রত্নতত্ত্বের কাজ সহজ ও আরামদায়ক ব্যাপার নয়।

    চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থী তুয়ান থিয়ান চিং ১৯৯৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ফিল্ড জরিপের সময় তাদেরকে গ্রামবাসীদের বাড়িতে থাকতে হতো। তারা প্রতিদিন ২ ঘন্টা হেঁটে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে যেতেন। ছাত্রীদের থাকার অবস্থা একটু ভালো ছিল, তবে ছাত্ররা সবসময় মাটির ঘরে থাকতেন, যে ঘরের দেয়াল কাগজ দিয়ে সাজানো, বৃষ্টি হলে মাটির ঘরে বেশ স্যাঁতসেঁতে ভাব দেখা যায় এবং দেয়ালের কাগজও খসে পড়ে। এমন ঘরে মোটা কাপড় পরলেও বেশ ঠাণ্ডা লাগে।

    এমন অভিজ্ঞতা সবার জন্য পরীক্ষার মতো। যারা এমন কঠিন অবস্থা সহ্য করতে পারেন না, তারা স্নাতক হওয়ার পর অবশ্যই প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাবেন না। যারা কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রত্নতত্ত্বের আমেজ অনুভব করেছেন, তারাই কেবল এ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার সুযোগ পেয়েছেন বা পেয়ে থাকেন।

    চীনের হ্যপেই প্রদেশের ওয়ে জেলার সানকুয়ান ধ্বংসাবশেষে কাজ করতে গিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গ্রামাঞ্চলের কঠোর অবস্থায় একসাথে থেকেছেন। তখন তারা কেবল প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক জ্ঞান অর্জন করেছেন তা নয়, বরং প্রত্যেকের ইচ্ছাশক্তির পরীক্ষাও হয়েছে এবং সবার মধ্যে মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।

    গত ৫০ বছর ধরে এ ধরনের প্রশিক্ষণ ও কাজ চলে আসছে। বিভাগের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কমপক্ষে দু’বার ফিল্ড জরিপ করতে হয়। তাদের ইন্টারর্নশিপও করতে হয় শানসি বা হ্যপেই প্রদেশের ধ্বংসাবশেষের কাছে, যেটি চীনের দূরবর্তী বা দরিদ্র গ্রামাঞ্চল।

    শিক্ষার্থীদের জন্য প্রত্যেকবারের ফিল্ড ট্রিপ শিক্ষকদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ সুযোগ। কারণ, শিক্ষকরা স্কুলের ক্লাসে সবসময় কঠোর থাকেন, শিক্ষার্থীদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠা তখন কঠিন। কিন্তু ফিল্ড জরিপের সময় সবাই একসাথে থাকেন, খাওয়া-দাওয়া করেন, কাজ করেন। তখন শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।  

    শিক্ষকদের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা তাঁদের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পেতে পারেন। গত ৫০ বছরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভিন্ন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা কাজ করতে গিয়ে সরল, বাস্তব ও ভালো চরিত্রেরও অধিকারী হয়েছেন। এ সম্পর্কে ২০ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ছাও স্যুয়ে ইয়ান বলেন, সিনিয়র অধ্যাপক বা যুবক শিক্ষকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এমন চরিত্রের অধিকারী হওয়া যায়, যা এ বিভাগে বিশেষভাবে সম্ভব।

    ২০২১ সালে বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয় রাঙ্কিংয়ে চীনের চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অবস্থান ছিল ৪৪তম এবং চীনের মধ্যে দ্বিতীয়। অনেকে জানতে চান, চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগ কিভাবে বিশ্বের প্রথম শ্রেণীতে দাঁড়িয়েছে? এ সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপকরা বলেন, যখন এ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকেই প্রতিষ্ঠাতারা বিশ্বমানের প্রত্নতত্ত্বকর্মী সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছেন। সেই চেষ্টা আজও অব্যাহত আছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

    চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠার সময় সাইবেরিয়ান প্রত্নতত্ত্ব কোর্স চালু হয় এবং গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে সর্বপ্রথম চীনে বিদেশের প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু হয়। এ বিষয় নিয়ে একটি প্রত্নতত্ত্বসংশ্লিষ্ট বইও প্রকাশিত হয়েছে।    

    বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইবেরিয়ান প্রত্নতত্ত্ব, ইউরেশিয়ান স্টেপের প্রত্নতত্ত্ব এবং উত্তর-পূর্ব এশিয়ার প্রত্নতত্ত্বসহ বিভিন্ন পেশাদার গবেষণাব্যবস্থা রয়েছে, যা বিশ্বমানের।

    প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উন্নত গবেষণা প্রযুক্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে ১৯৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় জীববিজ্ঞান একাডেমির সাথে সহযোগিতা করে দেশের প্রথম প্রত্নতত্ত্ব ডিএনএ পরীক্ষাগার গঠন করে। পরীক্ষাগারে দশ হাজারেরও বেশি প্রাচীন মানব, প্রাচীন প্রাণী ও উদ্ভিদের জিন সংগৃহীত হয়েছে।

    ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর চীনের শানসি প্রদেশের ইয়ুনছেং শহরের সিয়া জেলায় চিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব প্রশিক্ষণ ঘাঁটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। সেটি চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি মাইলফলক বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফিল্ড জরিপ স্থানীয় গ্রামবাসীদের বাড়ি থেকে ঘাঁটিতে স্থানান্তরিত হয়। এ ঘাঁটিতে বিভিন্ন পরীক্ষাগার রয়েছে; স্নানকক্ষ, বেডরুম রয়েছে; এসি ও গরম পানির ব্যবস্থা রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য যা সুখবর। এ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চাও পিন ফু বলেন, এখন যুগ বদলেছে। আমাদেরকে এখন আর আগের মতো কষ্ট করে ফিল্ড জরিপের কাজ করতে হয় না। ফিল্ড জরিপের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। ফলে, শিক্ষার্থীরা আরও মনোযোগ দিয়ে তাদের গবেষণাকাজ করতে পারছে।

    নতুন প্রত্নতত্ত্ব ঘাঁটিতে ২০ বছর বয়সী ছাও স্যুয়ে ইয়ানের মতো তরুণী শিক্ষার্থীরা নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রত্নতত্ত্বের খননকাজ করেন। ইউএভি রিমোট সেন্সিং, থ্রিডি স্ক্যানিং মডেলিংসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি এখন ব্যাপকভাবে প্রত্নতত্ত্ব গবেষণাকাজে ব্যবহার করা হয়। এখন চালকবিহীন গাড়ি প্রযুক্তিও পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা খননকৃত মাটি মোবাইল ফোনের এপিপি’র মাধ্যমে চালকবিহীন গাড়ির সাহায্যে সরিয়ে নিতে পারেন।

    মোদ্দাকথা, চীনের প্রত্নতত্ত্ব প্রযুক্তি কেবল রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও জীববিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ের সাথে যুক্ত নয়, বরং অন্যান্য গবেষণার সাথেও সংমিশ্রিত। চীনা সভ্যতার উত্স অনুসন্ধানে এ মেজর অবদান রাখছে ও ভবিষ্যতেও রেখে যাবে।  

    (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)