গত দশ বছরে বিশ্বের প্রতি চীনের আমন্ত্রণ
2022-12-30 19:34:30

 

গত দশ বছরে চীনে একের পর এক আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সারা বিশ্ব চীনকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে। আর চীন থেকে বিশ্বকে দেওয়া এক-একটি আমন্ত্রণ পত্র চীনের কূটনীতি এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে মৈত্রীর সাক্ষী হয়ে উঠেছে। আজ এই বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে কথা বলবো।

 

সময় ফিরে যায় ২০১৬ সালের শরত্কালে। সেই বছর চীনের হাংচৌ শহরে জি২০ শীর্ষসম্মেলন আয়োজন করা হয়। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে নৌকায় উঠে হাংচৌ শহরের বিখ্যাত পশ্চিম হ্রদের সুন্দর দৃশ্য উপভোগের আমন্ত্রণ জানালেন। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতারা একই নৌকায় ভবিষ্যতের কথা আলোচনা করেছেন।

চীনে একটি কথা প্রচলিত আছে: চীনের সুচৌ ও হাংচৌ শহরের দৃশ্য স্বর্গের মত সুন্দর। ২০১৫ সালে সি চিন পিং জি২০ সদস্য দেশের নেতাদেরকে হাংচৌ শহরে আসার আমন্ত্রণ জানান। বিভিন্ন দেশ এই আমন্ত্রণে সক্রিয়ভাবে সাড়া দিয়েছিল।

 

২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হাংচৌ আন্তর্জাতিক মেলা কেন্দ্রে সি চিন পিং শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানান এবং একসঙ্গে ছবি তোলেন।

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার ৩৫টি পতাকার সামনে সি চিন পিং মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন, পাশে পুরানো বন্ধুরা আছে এবং নতুন বন্ধুও আছে।

পশ্চিমা তথ্য মাধ্যমের খবরে বলা হয়, ইতিহাসে কখনই এমন অবস্থা হয়নি যে, এত বেশি দেশের নেতা একসাথে চীনে গিয়েছেন।

২০০৮ সালের আন্তর্জাতিক আর্থিক সংকটের পর জি২০ শীর্ষসম্মেলন জন্ম হয়। সেবারই জি২০ শীর্ষ সম্মেলন প্রথমবারের মত চীনে আয়োজন করা হয়।

অস্ট্রেলিয়ার তথ্য মাধ্যমের খবরে বলা হয়, বিভিন্ন দেশ ২০১৬ সালের জি২০ শীর্ষসম্মেলন আয়োজনের যোগ্যতা পেতে চায়, তবে চীন তা জয় করে। তা হল জি২০ সদস্য দেশের মতামত সংগ্রহ করার পর নেয়া সিদ্ধান্ত। সব দেশ চীনকে ভোট দিয়েছে।

এর পিছনে রয়েছে চীনের প্রতি সারা বিশ্বের আস্থা।

 

২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং তাঁর স্ত্রী মাদাম ফেং লি ইউয়ান হাংচৌ শহরে ভোজসভার আয়োজন করেন। তাঁরা জি২০ সদস্য দেশের অতিথিদের অভ্যর্থনা জানান।

সি চিন পিং তথ্য মাধ্যমে বলেন, দেশ বড় হোক, ছোট হোক, শক্তিশালী হোক, দুর্বল হোক, সব দেশেরই সমান মর্যাদা আছে। নিজেকে ভালোভাবে উন্নত করতে হবে, অন্য দেশের উন্নয়নে সাহায্য করতে হবে। সবাই ভালো হলে এই বিশ্ব আরো সুন্দর হতে পারবে।

 

এবারের শীর্ষসম্মেলনে বিশ্ব অর্থনীতি উন্নয়নে সি চিন পিং চীনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেন। উন্নয়ন হল এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামষ্টিক অর্থনীতির সমন্বয় জোরদার করা, উন্নয়নের পদ্ধতি উদ্ভাবন করা, বিশ্ব অর্থনীতির পরিচালনা সুসংহত করা ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশ সি চিন পিং-এর উত্থাপিত প্রস্তাবের ইতিবাচক সারা দিয়েছে।

২০১৭ সালের ১৪ মে সকালে বেইজিং রাষ্ট্রীয় সম্মেলন কেন্দ্রে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা শীর্ষ ফোরাম উদ্বোধন করা হয়। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এতে বক্তৃতা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ নির্মাণে সবাই আলোচনা করতে পারে। ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ নির্মাণের সুফল বিভিন্ন দেশ শেয়ার করতে পারে। ৪০ মিনিটের বক্তৃতায় ২৭বার সাধুবাদ পেয়েছেন তিনি।

 

২০১৩ সালের শরৎকালে সি চিন পিং আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ উত্থাপন করেছেন।

২০১৭ সালের শুরুতে সি চিন পিং বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামে চীনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, বেইজিংয়ে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা শীর্ষ ফোরাম আয়োজন করা হবে। যাতে বিভিন্ন দেশ যৌথভাবে সহযোগিতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে, সহযোগিতার মঞ্চ স্থাপন করতে পারে এবং সহযোগিতার সুফল শেয়ার করতে পারে।

ফোরাম উদ্বোধনের আগে সি চিন পিং বিভিন্ন দেশ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার নেতার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন। বিশ্লেষকরা বলেন, ফোরামে অংশগ্রহণকারী ৭০জনেরও বেশি নেতার মধ্যে প্রায় ৬০জন বিভিন্ন দেশের শীর্ষনেতা। এমন মর্যাদাপূর্ণ সম্মেলন খুব কম দেয়া যায়।

 

২০১৭ সালের ১৪ মে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বেইজিংয়ে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা শীর্ষ ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং ‘যৌথভাবে এক অঞ্চল, এক পথ নির্মাণ জোরদার করা’ শিরোনামে বক্তৃতা দিয়েছেন।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ নির্মাণ সব বন্ধুদের জন্য উন্মুক্ত। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দেশ ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ নির্মাণের আন্তর্জাতিক অংশীদার।

হাজার বছর ধরে প্রাচীন রেশমপথে বিভিন্ন দেশের জনগণের রচিত মৈত্রীর কথা এখনো সবার মনে আছে। বর্তমানে বিশ্বে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর উদ্যোগে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ আস্তে আস্তে বিশ্বকে কল্যাণকর ‘ধনী হবার পথ’ দেখিয়েছে। যা জনগণের কাছে ‘সুখের পথ’ হয়েছে।

 

এমন অনেক উদাহরণ আছে। চীনা প্রতিষ্ঠান সার্বিয়ার শত বছরের লোহার কারখানাকে সাহায্য করে এই কারখানা বন্ধ হবার পর থেকে আবার সমৃদ্ধ করে তুলেছে।

চীনা প্রতিষ্ঠান গ্রিসের বৃহত্তম বন্দরের উন্নয়নে সাহায্য করেছে। বন্দরটি আবারও ইউরোপের বড় বন্দরের সারিতে ফিরে গেছে।

করোনাভাইরাসের মহামারি প্রতিরোধে চীন ও ইউরোপের মধ্যে নিয়মিত মালামাল পরিবহন ট্রেন বিভিন্ন দেশের কাছে ‘প্রাণের ট্রেন’ হয়ে উঠেছে। ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ চীনের উত্থাপিত হলেও তা আসলে সারা বিশ্বের জন্যই।

 

এবার দেখব ২০১৮ সাল। সে বছর ছিল চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের ৪০ বছর পূর্তি। সেই বছরের ৫ নভেম্বর ‘চীন আন্তর্জাতিক আমদানি’ মেলা উদ্বোধন করা হয়। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের নেতা, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানসহ ১৫০০ জনেরও বেশি প্রতিনিধি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন।

তাদের মধ্যে ছিলেন ৭৪ বছর বয়সী চেক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট মিলোস জেম্যান। তার আগের বছর তিনি বেইজিংয়ে আয়োজিত ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা শীর্ষ ফোরামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে ফোরামে সি চিন পিং চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলার অভ্যর্থনা ভোজসভায় সি চিন পিং বলেছিলেন, এটি সাধারণ কোনো মেলা নয়, এটি নতুন দফা উচ্চ মানের উন্মুক্তকরণ জোরদার করায় চীনের নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এটি ছিল বিশ্বের কাছে চীনের বাজার উন্মুক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা।

 

ইথিওপিয়ার কফি, জাম্বিয়ার মধু, মিয়ানমারের জেড পাথর, প্রথম চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায় ৫৮টি ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ সংশ্লিষ্ট দেশের সহস্রাধিক প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। রেশমপথ বরাবর সংশ্লিষ্ট দেশ ও জনগণের জন্য আরো বেশি কল্যাণ সৃষ্টি করেছে।

সি চিন পিং বলেন, চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা প্রতি বছর আয়োজন করা হবে। আরো ভালোভাবে আয়োজন করতে হবে। কার্যকারিতা আরো ভালো হবে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের চারবার মেলার মধ্যে প্রথম মেলার স্বাক্ষরিত চুক্তির পরিমাণ ছিল ৫৭.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় মেলায় ৭১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, তৃতীয় মেলায় ৭২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাণিজ্যিক চুক্তি হয়। চার বছরে মোট স্বাক্ষরিত চুক্তির পরিমাণ ২৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।

সি চিন পিং-এর নিজস্ব বিন্যাসে ও উৎসাহে আয়োজিত চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা থেকে, সারা বিশ্ব চীনের বাজার উন্মুক্তকরণ এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চীনের সুযোগ শেয়ার করার আন্তরিকতা বুঝতে পেরেছে।

 

সময় ফিরে যায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই, মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিক গেমস আয়োজন শহর ঘোষণা করেছে; আর তা হল বেইজিং।

২০১১ সালের ৮ এপ্রিল, সি চিন পিং বেইজিং শীত্কালীন অলিম্পিক গেমসের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বলেন, চীনা জনগণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণের সঙ্গে বিভিন্ন কঠিনতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে, আবার একটি ঐতিহাসিক অলিম্পিক গেমস আয়োজন করেছে।

 

হ্যাঁ, যখন বেইজিং শীত্কালীন অলিম্পিক গেমস আয়োজনের যোগ্যতা পায়, তখন চীনা জনগণ এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ঠিক বেইজিং গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমস আয়োজনের ৭ বছর পর চীন আবারও বিশ্বকে শীত্কালীন অলিম্পিক গেমসের আমন্ত্রণ জানায়।

প্রতিশ্রুতি দেওয়া থেকে বাস্তবায়ন হওয়া পর্যন্ত, সাত বছরে সি চিন পিং ৫বার প্রস্তুতি কাজ পরিদর্শন করেছেন। সবুজায়ন, ভাগাভাগি, উন্মুক্তকরণ এবং দুর্নীতিমুক্ত অলিম্পিক গেমস আয়োজনের চিন্তাধারা থেকে ‘সহজ, নিরাপত্তা, চমৎকার’ অলিম্পিক গেমস আয়োজনের চাহিদা পর্যন্ত, স্টেডিয়ামের নির্মাণ থেকে মহামারি প্রতিরোধ ব্যবস্থা পর্যন্ত, সি চিন পিং বার বার গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন।

 

২০২২ সালে চীনের ঐতিহ্যবাহী বসন্ত উৎসবের আনন্দময় আমেজে, বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়রা হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে বেইজিংয়ে হাজির হন।

উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানে চীনের সাংস্কৃতিক উপাদান দিয়ে আয়োজিত গালা সবাইকে সুন্দর স্মৃতি উপহার দিয়েছে।

প্রতিযোগিতার মাঠে খেলোয়াড়রা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মানের শক্তি দর্শকদের দেখিয়েছেন।

অলিম্পিক গেমস শান্তি, ঐক্য ও অগ্রগতি সম্বন্ধে মানবজাতির সুন্দর আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়। এখন বিশ্বে করোনাভাইরাসের মহামারি শেষ হয় নি; বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ বার বার দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় মানবজাতির ভবিষ্যত কোন দিকে যাচ্ছে?

আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিশনের চেয়ারম্যান টমাস বাখের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সি চিন পিং বলেন, অলিম্পিক গেমসের চেতনার মধ্যে ‘আরো ঐক্য’ হল বর্তমান যুগে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ১৯০টি ছোট নৌকায় আলাদা নয়, বরং সবাই একটি বড় নৌকায় আছে। সব দেশ যৌথভাবে আরো সুন্দর ভবিষ্যত অর্জন করছে।

‘আরো ঐক্য’, ‘একসঙ্গে ভবিষ্যতের দিকে যাওয়া’ মানবজাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

ভবিষ্যতের দিকে তাকালে, সি চিন পিং বার বার জোর দিয়ে বলেছেন যে, ইতিহাসের সঠিক পথে থাকতে হবে। ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ থেকে বহুপক্ষবাদের চিন্তাধারায় আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধান করা পর্যন্ত, মানবজাতির অভিন্ন ভাগ্যের কমিউনিটি গড়ে তোলার জন্য তিনি সবসময় চেষ্টা করছেন।

 

শুয়েই/তৌহিদ