সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগিয়ে গেলে হাইওয়ে’র পাশে একটি কারখানার দেখা মিলে।এটি ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্মেদেরেভো ইস্পাত প্ল্যান্ট।এটি সার্বিয়ার বৃহত্তম ইস্পাত উত্পাদন প্রতিষ্ঠান। এ কারখানার দরজায় একটি বিশাল স্লোগান চোখে পড়ে। সেখানে লাখা আছে “সার্বিয়ার গৌরব”।
২০১৬ সালের জুন মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সার্বিয়া সফরকালে এ কারখানা সফর করেন। শ্রমিকরা ইস্পাত দিয়ে তৈরি করে সি চিন পিংকে বিশেষ একটি উপহার দিয়েছেন। সেটি হলো ইস্পাত প্ল্যান্ট সিলুয়েট স্মারক ফলক। এ ফলকে স্টিল মেকিং ব্লাস্ট ফার্নেস, এক্সস্ট চিমনি, প্রসেসিং ওয়ার্কশপসহ নানা সিলুয়েট রয়েছে। এ ফলকের পিছনে রয়েছে একটি শতাধিক বছরের ঐতিহাসিক পুরনো কারখানার চীনের সহযোগিতায় পুনরুজ্জীবনের গল্প।
এ ইস্পাত কারখানা একসময় সার্বিয়ার স্তম্ভফলক প্রতিষ্ঠান ছিল। এটি শহরের ৪০ শতাংশ আর্থিক কর প্রদান করতো এবং তিন ভাগের একভাগ বাসিন্দা সেখানে কাজ করতেন। এমনকি স্থানীয় বাসিন্দারা সে সময় সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরপরই চিমনি দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন। সে চিমনিতে ধোঁয়া দেখতে পেলে তারা বুঝতেন যে ইস্পাত কারখানার সবকিছু ঠিক-ঠাক চলছে। তা তাদের মনকে শান্ত রাখতো।
তবে, গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের শেষ দিকে, প্রতিদ্বন্দিতার সক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে এ কারখানা মন্দাবস্থায় পড়ে যায়। এমনকি এ কারখানাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করে। বিক্রি করে দেয়া এবং বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণের পর এর একমাত্র চিমনির স্বাভাবিক কাজ চলে।
এ কারখানাকে বাঁচানোর জন্য সার্বিয়া সরকার বিদেশী বিনিয়োগ সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়েছে। তবে, সফল হয়নি। তত্কালীন সার্বিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইছিচি ভুসিসি বলেছেন, ‘আমরা এ কাজের জন্য দিনরাত ধরে কষ্ট করেছি। মন্ত্রিসভার সকলে অনেক চেষ্টা চালিয়েছেন। অবশেষে চীনের সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব আমাদেরকে আশার আলো প্রদান করেছে।’
২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের আওতায় চীনের হে কাং গ্রুপ ৪ কোটি ৬০ লাখ ইউরো দিয়ে এ কারখানা ক্রয় করেছে। এর মাধ্যমে হে কাং গ্রুপ সার্বিয়ায় তার ইস্পাত কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে সার্বিয়ানদের মাঝেও সন্দেহ ছিল যে কয়েকজন চীনা আসলে কাজ হবে কি? বাস্তবতা সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে।
হে কাং গ্রুপ কোম্পানি ২০টিরও বেশি প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেমন, ইস্পাতের বর্জ্যের অবশিষ্টাংশ পুনঃব্যবহার, অর্থনৈতিক মালামালের মধ্য দিয়ে আরও উচ্চ মানের ইস্পাত তৈরি করা এবং দুই নম্বর চিমনি আবারও জ্বালানো। ছয়মাস পর এ ইস্পাত কারখানা পুনরায় মুনাফা লাভ করেছে। ২০১৮ সালে এটি সার্বিয়ার বৃহত্তম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ কারখানার উত্পাদিত ইস্পাত ৩০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে রপ্তানি করা হয়েছে। পাঁচহাজারের বেশি কর্মচ্যুত কর্মী পুনরায় কারখানার কাজে ফিরে এসেছেন।
একটি ইস্পাত কারখানাকে বাঁচানোর পর হাজারটি পরিবার উপকৃত হয়েছে। আশি বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত কর্মী আলেক্সান্ডার চ্যানকোভিছ বলেছেন, তার বাসায় তিনি চীন ও সার্বিয়ার পতাকা ভালোভাবে রেখেছেন। একবার তিনি চীনা ব্যবস্থাপকদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি যুদ্ধ ও দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছিলেন। বর্তমানে তার পরিবারের চার প্রজন্মের সদস্যরা ইস্পাত কারখানায় কাজ করছেন। তারা এখন শান্ত ও সুন্দর জীবন কাটাচ্ছে।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট বেইজিংয়ে সি চিন পিং’র সঙ্গে সাক্ষাতের সময় বলেন, ইস্পাত কারখানাটি মরে যেতে যেতে বেঁচে গেলো। এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ সার্বিয়ার জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।
শুধু সার্বিয়া নয়, “এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ ইন্দোনেশিয়া, গ্রীসসহ অনেক দেশে এ ইস্পাত কারখানার মতো অনেক প্রতিষ্ঠানকে পুনরুজ্জীবন দান করেছে। বর্তমানে চীনের ৩৪০০টি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ বরাবর অঞ্চলের প্রকল্পগুলো নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য এ উদ্যোগ মানে জল, বিদ্যুত্, রাস্তা ও সেতু। তাতে সদিচ্ছা পূরণের আশার আলো দেখা দেয়।