শিশুদের সাহায্য করা একজন সাধারণ পুরুষের গল্প
2022-12-25 17:51:31

তাঁর নাম কৌ চিয়া পিং, চীনের কুইচৌ প্রদেশের মানুষ, বয়স ৪৩ বছর। তিনি পাহাড়ি অঞ্চলের অতি সাধারণ পুরুষ।

গত দশ বছরে, তিনি গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন। জরাজীর্ণ ও ভাঙা স্কুল ভবন দেখে, নতুন কাপড় পরতে না-পারা শিশুদের দেখে, তিনি তাদের জন্য নতুন কাপড়, নতুন জুতা, নতুন ক্রীড়া যন্ত্র, নতুন বই, নতুন কম্পিউটার কিনে দিয়েছেন। তিনি গ্রামের একজন কর্মকর্তা। তবে, তিনি কৃষকদের বাদাম বিক্রিতে সহযোগিতা করেন। তিনি নিজ খরচে বাদাম কিনেছেন। গ্রামের সেতু ও পথ নির্মাণে তিনি বিভিন্ন দিক থেকে সহায়তা সংগ্রহ করেছেন। তিনি শুধু চেয়েছেন লোকজনের আয় কিছুটা বাড়ুক।

 

তাঁর ‘আলো’ ও ‘উষ্ণতা’ কাছের অনেক মানুষকে মুগ্ধ করেছে। এর ফলে ৫০ লাখেরও বেশি আর্থিক সহায়তা এসেছে গ্রামে। এতে ১ হাজারেরও বেশি দরিদ্র শিশু সাহায্য পেয়েছে, তাদের মধ্যে ১২০ জনেরও বেশি ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে।

২০১২ সালে কৌ চিয়াং পিং তাঁর গ্রামে শিক্ষাদানের জীবন শুরু করেন। স্থানীয় সি বান থানা চরম দরিদ্র একটি জায়গা। আসলে এক বছর শিক্ষাদানের পর তিনি জেলায় ফিরে যেতে পারেন। তখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে বলেন, সবচেয়ে দূরত্বের চিনসান প্রাথমিক স্কুলে কোনো শিক্ষক যেতে চায় না। প্রিন্সিপালও পদত্যাগ করেছে। শিক্ষা সংস্থা তাঁকে চিনসান প্রাথমিক স্কুলের প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ করতে চায়।

 

চিনসান প্রাথমিক স্কুলের অবস্থা অনেক খারাপ। দরজা, জানালা, সবই ভাঙাচরা, একটি ডেস্ক চারটি শিশু একসাথে ব্যবহার করে। শিশুদের কাপড় খুব জরাজীর্ণ, শীতকালেও শিশুদের পায়ে গ্রীষ্মকালের জুতা।

কৌ বলেন, পুরো স্কুলে ৭৫টি শিশু আছে, তাদের বাবা মা সবাই শহরে চাকরি করে। এত বেশি অসহায় শিশু দেখে তিনি সেই স্কুলে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

চিনসান গ্রামে পানির প্রচণ্ড অভাব। কৌ শিক্ষকদের নিয়ে এক কিলোমিটার দূরের জায়গা থেকে শিশুদের জন্য পানি নিয়ে আসেন। চরম আবহাওয়ায় তিনি ও শিক্ষকরা শিশুদের কাঁধে করে স্কুলে পৌঁছে দেন। তুষারপাতের দিন তিনি গভীর পাহাড়ি এলাকায় শিশুদের বাসায় গিয়ে খোঁজখবর নেন।

 

কৌ জানান, আগে তাঁর দাতব্য কাজ সম্পর্কে বেশি ধারণা ছিল না। তবে, সেখানকার শিশুদের কষ্টকর লেখাপড়া দেখে তিনি দাতব্য কাজের চিন্তা শুরু করেন। ২০১৩ সালে একটি ওয়েবসাইটে দেখেন যে, কুই ইয়াং শহরে একটি সংস্থার কিছু পুরানো কাপড় আছে। তাই তিনি সেই সংস্থাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন যে, এসব পুরানো কাপড় কি স্কুলের শিশুদের দেওয়া যায়? অক্টোবর মাসে এক ভীষণ বৃষ্টির দিনে, সংস্থার প্রধান এসইউভি গাড়ি চালিয়ে গভীর পাহাড়ি সেই স্কুলে যান। স্কুলের অবস্থা দেখে তিনি বলেন, এখানকার শিশুদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা এত কষ্টের। মাত্র এক সপ্তাহে সংস্থাটি ৩ সহস্রাধিক কাপড় স্কুলে পৌঁছে দেয়। তখন কৌ সব কাপড়কে ক্লাসরুমে রাখেন, পুরো গ্রামের লোকজন কাপড় নিতে পারে, সবাই অনেক খুশি হয়, তখন সবাইকে পোশাক দেওয়া হয়।

 

কৌ বলেন, তখন তিনি শুধু একটি ফোন করেছিলেন, তবে সংস্থার লোকজন ভীষণ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কয়েকশ’ কিলোমিটার দূর থেকে স্কুলে এসেছেন এবং সাহায্য করেছেন, তিনি কখনই এমন কাজের কথা কল্পনা করতে পারেন না। যা চিনসান গ্রামের লোকজনের জন্য তাঁর প্রথম কাজ। এর মাধ্যমে তিনি এই দাতব্য কাজ অব্যাহতভাবে করেন।

 

২০১৫ সালে দেশের অনেক স্কুলে দুপুরে পুষ্টিকর খাবারের প্রকল্প শুরু হয়। চিনসান গ্রামের অবস্থাও অনেক উন্নত হয়েছে। তবে, চিনসান প্রাথমিক স্কুলে কলের পাইপে পানির ব্যবস্থা নেই, বিদ্যুতের অভাবও রয়েছে। এই কারণে পুষ্টিকর দুপুর খাবারের ব্যবস্থা করা যায় নি। অনেক শিশুর বাবা-মা বাসায় নেই, শহরে কাজ করে, আর দাদা-দাদি অনেক ভোর থেকে পাহাড়ে গিয়ে কৃষিকাজ করে। তাই তারা শিশুদের নাস্তার ব্যবস্থা করতে পারে না। স্কুলেও দুপুরের খাবার নেই, শিশুরা খালি পেটে সারা দিন কাটায়। কৌ এই অবস্থা দেখে খুব মর্মাহত হন।

 

ছয় শ্রেণীর শিশু চৌ দ্য হুং দীর্ঘসময় ধরে পুষ্টির অভাবে পাকস্থলীর রোগে আক্রান্ত হয়, তাদেরকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুদের কষ্ট দেখে কৌ আর সহ্য করতে পারেন না, তিনি শিক্ষা ব্যুরোতে গিয়ে দাবি করেন: অন্য স্কুলে পুষ্টিকর খাবার আছে, কেন আমাদের চিনসা স্কুলের শিশুদের জন্য খাবার নেই? আপনারা এই সমস্যা সমাধান না করলে আমি প্রিন্সিপালের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করবো।

 

সেই গ্রীষ্মকালে স্কুলের ক্যান্টিন নির্মাণের জন্য কৌ স্কুলে পুরো গ্রীষ্মকালে ছুটি দেন, তিনি নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধান করেন।

গ্রামবাসী ওয়াং হুই-এর মনে আছে, ১ সেপ্টেম্বর স্কুলের নতুন সেমিস্টার শুরুর দিনে, দুপুরে স্কুলের ক্যান্টিনে চারটি খাবার রান্না করা হয়, তাতে অনেক মাংস ছিল। শিশুরা অনেক খাবার খেয়েছিল। অনেক শিশুর আত্মীয় স্কুলে এসেছেন, শুধুই শিশুদের ভালো খাবার খাওয়া দেখার জন্য।

 

কৌ-এর স্ত্রী একজন রাস্তা পরিষ্কারকর্মী। প্রতি মাসে তাঁর বেতন ১৪০০ ইউয়ান। তাঁর মেয়ে লেখাপড়া করছে, পুরো পরিবারে টাকার প্রয়োজন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, কৌ চিনসান প্রাথমিক স্কুল ত্যাগ করেন এবং থানায় সরকারি কাজ করতে শুরু করেন। তাঁর বেতন আগের ৫৩০০ ইউয়ান থেকে কমে ৪২৫০ ইউয়ান হয়েছে। তবে তিনি বলেন, তিনি কখনই অনুতপ্ত হন নি। সরকারের সহযোগিতায় তিনি আরো বেশি সম্পদ লাভ করেছেন, তিনি আরো বেশি দাতব্য কাজ করতে পেরেছেন।

 

২০১৮ সালে চিনসান স্কুল অন্য স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়। এজন্য আটটি শিশু কাছাকাছি গ্রামে লেখাপড়া করতে পারে। যাওয়া-আসার গাড়ির ফি তাদের পরিবারের জন্য একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কৌ তাদের জন্য ৯৬০০ ইউয়ান গাড়ি ভর্তুকি সংগ্রহ করেন এবং তাদেরকে ভালোভাবে লেখাপড়া করার ক্ষেত্রে উত্সাহ দেন। ১০ বছরে ধরে চেষ্টার পর চিনসান গ্রাম থেকে ৮০ জনেরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তৈরি হয়।

 

চিনসান গ্রামের জমির গুণগতমান ভালো না, কৃষি প্রকল্প বেশ কঠিন। সেখানে শুধু বাদাম চাষ করা যায়। চিনসান গ্রামে তরুণ মানুষের সংখ্যা কম। প্রত্যেক পরিবার বাদাম চাষ করে, তবে গ্রামবাসীরা তা বাইরে বিক্রি করতে পারে না।

২০১৯ সাল থেকে টানা তিন বছর ধরে কৌ প্রতি কেজি বাদাম ১০ ইউয়ান দিয়ে পরিবারগুলো থেকে কিনেছেন। তারপর তা বন্ধুদের কাছে বিক্রি করেছেন, যাতে কৃষকদের বাদাম বিক্রিতে সাহায্য করা যায়। যে দাম তিনি কৃষকদের দেন, তা বাজারের দামের চেয়ে অনেক বেশি। এতে কৃষকদের আয় ভালো হয়েছে।

 

কৌ নিজের ফোন নম্বর কৃষকদের দিয়েছেন এবং তাদের বলেন, তোমাদের বাদাম আমার কাছে বিক্রি করো, যদি বিক্রি করতে না পারো, তাহলে থানার সরকারি কর্মীরা তা কিনে নেবে। নিশ্চয় তোমাদের বিক্রির সমস্যা সমাধান করবো আমরা। তিন বছর ধরে কৌ চিনসান গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে ৩০ কেজি বাদাম কিনে অন্য জায়গায় বিক্রি করেছেন।

 

কৌ-এর সাহায্য পাওয়া একজন শিশু কৌকে চিঠি লিখে বলেন: আপনি আমাদের চার ঋতুতে আশার বীজ রোপণ করেছেন। এই ছোট বীজ যখন বড় হলে নিশ্চয়ই বড় একটি গাছ হবে। তখন এই গাছ তোমাদের জন্য প্রচুর সূর্যের আলোর প্রতিরোধ করবে। অবশ্য, এই বড় গাছ আরো বেশি বীজ রোপণ করবে, এই ভালোবাসা ছড়িয়ে দেবে।

 

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)