চীনের তুং থিং হ্রদের গল্প
2022-12-21 15:55:11

তুং থিং হ্রদ চীনের হু নান এবং হু পেই প্রদেশের মধ্যে অবস্থিত। প্রাচীনকাল থেকে কবিগণ এর সুন্দর দৃশ্য নিয়ে অনেক কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন। ওই সব লেখায় পরিষ্কার ও বিশাল এ হ্রদের বর্ণনা পাওয়া যায়।

 

তবে, মাত্র কয়েক বছর আগেও তুং থিং হ্রদ অন্য রকম ছিল। এর প্রাকৃতিক পরিবেশ গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অবৈধভাবে অতিরিক্ত মাছ ধরার কারণে এর মত্স সম্পদও কমে গিয়েছিল। কারখানার দূষিত পানি হ্রদে পড়ে এর পরিবেশ নষ্ট হয়েছিল। ফলে ২০১৩-২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে তুং থিং হ্রদের ১১টি এলাকার মধ্যে ৫টির পানির মানের অবনতি হয়েছিল।

 

২০০৬ সালে ৩০ বছরে সবচেয়ে ভয়াবহ খরায় ভুগেছে তুং থিং হ্রদ। ফলে হ্রদের নিজস্ব পরিশুদ্ধিকরণ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার কারণে তুং থিং হ্রদের দূষণ তখন সবচেয়ে গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তখন তুং থিং হ্রদের চারপাশের তিনটি শহরে বহু কাগজ কারখানা ছিল এবং অধিকাংশ কারখানায় ছিল না বর্জ্য জল প্রক্রিয়াকরণ সরঞ্জাম। তারা সরাসরি বর্জ্যপানি হ্রদে নিঃসরণ করতো বলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও হ্রদের পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 

২০১২ সালের ৩ মার্চ থেকে  এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এক মাসে মোট ১৯টি ডানাহীন ডলফিন মারা যায়। এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৬টির মৃত্যু হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষ এ অঞ্চলে কীটনাশক ছড়িয়েছে এবং বৃষ্টির কারণে তাতে পানি দূষিত হয়ে হ্রদে প্রবেশ করেছে। তা ছাড়া,  জেলেরা বিদ্যুত জাল দিয়ে মাছ ধরে ডলফিনের ক্ষতি করেছে। ডানাহীন ডলফিন চীনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংরক্ষিত প্রাণী। আর পৃথিবীতে তারা ২.৫ কোটি বছর ধরে বেঁচে আছে। এ প্রাণী কেবল তুং থিং হ্রদসহ কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় বাস করে। ২০১২ সাল থেকে তার সংখ্যা প্রতিবছর ৫ শতাংশ করে কমেছে।

 

ডানাহীন ডলফিন  রক্ষায় স্থানীয় মত্স্য বিভাগ নির্দিষ্ট এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে নির্ধারণ করেছে। সেখানে যে কোনো ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। পাশাপাশি, জাহাজ চলার গতি, আকার, রুটসহ নানা ক্ষেত্রে নিয়ম চালু করা হয়। জল সংরক্ষণ ড্রেজিং প্রকল্প এবং জলাভূমি সুরক্ষা প্রকল্পগুলোর মতো পরিবেশগত ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হয়। যাতে করে ডানাহীন ডলফিনের জীবনের পরিবেশ উন্নত করা যায়।

 

২০২০ সাল থেকে তুং থিং হ্রদসহ নানা জলরাশিতে পর্যায়ক্রমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা শুরু হয়। লাখ লাখ জেলে মাছ শিকারী থেকে মাছ রক্ষাকারীতে পরিণত হন।

 

১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণকারী সি  চুং ফাং একজন জেলে ছিলেন। তিনি তুং থিং হ্রদের মাঝখানে  লিয়ান হুয়া আও নামের একটি দ্বীপে বাস করতেন। সেখানকার সবাই মাছ ধরতেন। সি চুং ফাং তার পরিবারের সপ্তম প্রজন্মের জেলে এবং ১৪ বছর বয়স থেকে মাছ ধরা শুরু করেন।

 

২০২০ সালে মাছ ধরা নিষিদ্ধ হবার পর সে দ্বীপের মানুষদের জীবিকা নির্বাহে সমস্যা দেখা দেয়। সেখানে ছিল না কোনো স্কুল বা হাসপাতাল। তাই  দ্বীপের বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনার পর সবাইকে নতুন গ্রামে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। হ্রদের পাশে সরকার জেলে পাড়া নামে একটি নতুন গ্রাম নির্মাণ করে এবং সবাই সেখানে চলে যান। যে দিন নতুন গ্রামে যান সেদিন সি ছুং ফাং পুরাতন বাড়ির সামনে তার স্ত্রীর রোপন করা কিছু ফুল এবং গাছপালা ফেলে আসেন। তিনি বলেছেন, এগুলো তিনি নেবেন না কারণ তারা এ দ্বীপে ইচ্ছা মতো বড় হতে পারবে। সেদিন সূর্যাস্ত দেখে তিনি বলেছেন, দ্বীপে আমি সূর্যাস্ত দেখতে পছন্দ করি। যদিও সবাই পরিচিত পরিবেশ ত্যাগ করতে চান না; তবে, তারা বুঝেন, মাছ  না ধরা হবে হ্রদ, মত্স সম্পদ  সংরক্ষণ এবং তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য উপকারী।

 

সি ছুং ফাং এখন পরিবারের সঙ্গে একটি মাছ রেঁস্তোরার ব্যবসা করছেন। জেলেরা মাছ ভাল রান্নাও করতে পারেন। ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে তার রেঁস্তোরার  নীট মুনাফা ছিল ১ লাখ ইউয়ান। নতুন গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি পরিষেবা কোম্পানি। প্রবীণরা এখানে পরিষ্কার কর্মী হিসেবে কাজ করতে পারেন। সবাই নতুন জীবন শুরু করেছেন।

 

হ্য তা মিং এবং হ্য তুং সুন বাবা ও ছেলে। তারা জেলেদেরকে নিয়ে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করেন। তাদের পূর্বপুরুষগণ তুংথিং হ্রদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এখন তারা এ হ্রদ রক্ষা করেন। হ্য তুং সুন ১৯৯৭ সালে জেলে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট বেলায় বাবার সঙ্গে মাছ ধরতেন। ২০০৩ সালে হ্য তা মিং তুং থিং হ্রদ থেকে দুটি  ডানাহীন ডলফিন উদ্ধার করেছিলেন।  চার মাসের মতো তাদের যত্ন নিয়েছিলেন। তখন থেকে হ্য তা মিং পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতন হন। পরে তার উদ্যোগে একটি ডানাহীন ডলফিন সংরক্ষণ সেচ্ছাসেবক দল প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এ দল ইউয়ে ইয়াং শহরের পূর্ব তুং থিং হ্রদের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটিতে পরিণত হয়।

 

২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হবার পর বাবার প্রভাবে হ্য তুং সুন পরিবেশ সংরক্ষণ কাজ শুরু করেন। এখন তিনি বাবাকে পরামর্শ দেন যে তারা পাখি, হরিণ সংরক্ষণ, জাহাজের বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণসহ নানা ক্ষেত্রে তাদের কাজ সম্প্রসারিত করতে পারে। তিনি বাবার মতো সারা জীবন তুং থিং হ্রদ রক্ষা করতে চান। তিনি আশা করেন, যখন তার বাচ্চা বড় হবে, তখন তুং থিং হ্রদের প্রকৃতি পুনরুদ্ধার হবে। তার বাচ্চা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কাজ করতে পারবে।

 

হু নান প্রদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিভাগের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২০২২ সালে তুং থিং হ্রদে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা টানা ৫ বছর বৃদ্ধি পেয়ে  ৪ লাখ ৪ হাজারে দাঁড়ায়। তখন ডানাহীন ডলফিনের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩০টিতে।

(শিশির/এনাম/রুবি)