‘সুখ’ ও ‘পরিবার’কে যুক্ত করেছে যে সেতু
2022-12-14 11:18:42

চীনের হু নান প্রদেশের সিয়াংসি থুচিয়া ও মিয়াও জাতি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের চি শৌ শহরের ত্য হাং  উপত্যকার দু পাশে অবস্থিত দুটি মিয়াও জাতির গ্রাম। একটির নাম পরিবার আর আরেকটির নাম সুখ। দশ বছর আগে সুখ গ্রামের ছেলে ও পরিবার গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করতে যেতে  এক দিনের মতো সময় লেগে যেতে; যদিও দুটি গ্রামের মধ্যে দূরত্ব  মাত্র ৫ কিলোমিটার।

 

দুই গ্রামের মাঝে থাকা এক একটি পাহাড় ও উপত্যকা স্থানীয়দের দারিদ্রমুক্তি ও সমৃদ্ধ জীবনের পথে বাধা ছিল। ওই সময় তাদের জন্য সহজে স্বজন ও বন্ধুকে দেখতে যাওয়া, কৃষি পণ্য পাহাড়ের বাইরে বিক্রি করা এবং বাইরে ভ্রমণে যাওয়া অসম্ভব স্বপ্ন ছিল।

 

তবে, তাদের স্বপ্ন অবশেষে বাস্তবে পরিণত হয়; একটি সেতু এ সমস্যা সমাধান করে। আইচাই সেতু নির্মিত হবার পর সুখ থেকে পরিবার গ্রামে যেতে এখন মাত্র দশক মিনিট সময় লাগে।

 

এ সেতু শুধু গ্রাম দুটি এবং চারপাশের গ্রাম ও জেলার মানুষদের আসা-যাওয়ার সুবিধা সৃষ্টি করেছে- তা নয়, বরং স্থানীয় অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে কাজ করছে। চলতি বছর এ সেতু নির্মিত হওয়ার ১০ বছর পূরণ হয়েছে।  গত দশ বছর ধরে এ সেতু স্থানীয় দারিদ্রবিমোচন কাজের সাক্ষী।

  

 আইচাই সেতু চালু হবার আগে হু নান প্রদেশ ও ছুংছিং শহরের মধ্যেকার  মূল স্থল পথ ছিল ৩১৯ নম্বর রাষ্ট্রীয় রাস্তা। আর এ রাস্তা আগে ছিল ১৯৩৭ সালে নির্মিত হু নান-সি ছুয়ান সড়ক পথ। এ পথ চি সৌ শহরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। ঘূর্ণায়মান পাহাড়ি এ রাস্তাটি পাহাড়ের মাঝখানে বাঁক নেয়। মোট ৬ কিলোমিটার পাহাড়ি পথে রয়েছে ১৩টি তীক্ষ্ণ বাঁক। সবচেয়ে সরু জায়গা মাত্র ৪ মিটারের কম।এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং অস্বাভাবিক, যা "বিশ্বের মহাসড়কের বিস্ময়" নামে পরিচিত। পাশাপাশি, রাস্তার অবস্থাও ভাল না। প্রায় প্রতিদিন যানজট হয় এবং মাঝে মাঝে গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু তারপরও প্রতিদিন হাজার হাজার এমনকি ১০ হাজারের বেশি গাড়ি এ পথে চলে; এর ৭ ভাগ ভারী ট্রাক।

আইচাই সেতুর নির্মাণও সহজ ছিল না। এমন কঠিন কাজ আগে আর দেখা যায়নি।  নির্মাতাদের সঙ্গে দুটি গ্রামের  যুবকরাও কাজ করেছেন। মোট ৩৩০ মিটার উঁচু জায়গায় সেতু নির্মাণ কতটা ভীতিজনক তার কিছুটা হলেও অনুমান করা যেতে পারে।

২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। সে বছরের ৩১ মার্চ সেতুটি  আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে। স্থানীয়দের জন্য ওই দিনটি ছিল বড় একটি দিন, তাই তারা  উত্সবের বিশেষ পোশাক পরে সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠান দেখতে আসেন।

গত ১০ বছরে আইচাই সেতু এখন স্থানীয় পর্যটনের কেন্দ্রীয় ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। সেতুকে কেন্দ্র করে মিয়াও জাতির গ্রাম নিয়ে একটি পর্যটন এলাকা তৈরি করা হয়। একে কেন্দ্র করে চা চাষ ও পারিবারিক হোটেল শিল্পও দ্রুত উন্নত হয়। গত ১০ বছরে আইচাই সেতুর সুবিধা কাজে লাগিয়ে স্থানীয় মিয়াও জাতির মানুষের দারিদ্র্যমুক্ত করেছে সুখ ও পরিবার গ্রামকে। দুটো গ্রামের গল্পের মাধ্যমে স্থানীয়দের জীবনযাপনের পরিবর্তন বোঝা যায়।

 

১৯৯১ সালে জন্মগ্রহণকারী ইয়াং মেই খাই একজন মিয়াও জাতির মেয়ে এবং তিনি গ্রামে ফিরে ব্যবস করছেন। তার মামার পুরাতন বাড়ি ভাড়া নেন এবং সজ্জিত করে হোটেল ব্যবাসা শুরু করেন। তার হোটেলে সর্বোচ্চ ১০০ জন লোক একসঙ্গে খেতে পারেন। তখন প্রতিসপ্তাহে তার আয় হয় ১০ হাজার ইউয়ান। পাশাপাশি, তিনি নতুন ব্যবসার সুযোগ খুঁজে পান। তার সঙ্গে গ্রামের নারীরা একটি মিয়াও জাতির সূচিকর্ম স্টুডিও খুলেন এবং পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী তারা নানা হস্তশিল্প তৈরি করেন। একটি শিল্পকর্মের দাম ১০০ ইউয়ান থেকে ৭০০-৮০০ ইউয়ান পর্যন্ত হয়। পর্যটকরা এসব  খুব পছন্দ করেন এবং স্থানীয়দের আয়ও বেশি হয়।

আটত্রিশ বছর বয়সী হুয়াং ইউং ১০ বছর আগে যখন সেতুটি চালু হয়েছিল, তখন গ্রামে ফিরে আসেন। সেতুতে তিনি ছবি তোলার ব্যবসা শুরু করেন। তার ব্যবসাও ভাল চলছিল। পরে সবাই মোবাইল ফোন দিয়ে ছবি তুলাশুরু করলে তিনি  ব্যবসা বন্ধ করে দেন। এবং পারিবারিক হোটেল ব্যবসা করেন। তিনি পাঁচতলা একটি ভবন নির্মাণ করেন। প্রথম তলায় একটি রেস্টুরেন্ট খুলেন। দ্বিতীয় তলায় তিনি বাস করেন।  তিন থেকে পাঁচ তলা পর্যন্ত গেস্ট হাউজ বানান। পর্যটকরা সেতু দেখার পর এখানে এসে আশ্রয় নেন। সত্তর বছর বয়সী প্রবীণ নারী বলেছেন, আমি ৭০ বছর বয়সী, তবে এ বাড়ির সামনে বসে চা পাতা বাছাই করতে পারছি। প্রতিদিন যে চা পাতা আমি তুলি- তা বিক্রি করে ২০০-৩০০ ইউয়ান পায়। আমি মাঝেমাঝে গ্রামের কয়েক জনের সঙ্গে মিলে ভ্রমণ করতে যাই। নানজিং, বেইজিং সব জায়গায় আমি গিয়েছি।  বুলেট ট্রেন,সাবওয়েতে বসেছি। সেতু চালু হবার পর অনেক সুবিধা হয়েছে। সুখি গ্রামের মানুষ আসলে সুখি হয়েছে।

   সেতু এ বিশ্বকে ছোট করেছে,  তবে মিয়াও গ্রামকে বড় করেছে। স্থানীয়দের জীবনযাপন পরিবর্তনের গল্প শেষ হয়নি। তারা আরও উন্নত জীবনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে ।(শিশির/এনাম/রুবি)