দেহঘড়ি পর্ব-৯৯
2022-12-09 19:31:23

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে প্রাকৃতিক উপায়ে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় নিয়ে আলোচনা ‘ভালো থাকার আছে উপায়’, সাক্ষাৎকারভিত্তিক আয়োজন ‘আপনার ডাক্তার’ এবং খাদ্যের পুষ্টিগুণ নিয়ে আলোচনা ‘কী খাবো, কী খাবো না’।

# আপনার ডাক্তার

দেহঘড়ির আজকের পর্বে আমরা কথা বলেছি হৃদরোগের নানা দিক নিয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, বিশ্বে ১২৮ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এদের দুই-তৃতীয়াংশের বাস বাংলাদেশসহ নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করেন, যার অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ। দেশে প্রতি পাঁচ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে এক জনের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে তরুণদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ জন তরুণের মধ্যে এক জন হৃদরোগ ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পৃথিবীব্যাপী মোট মৃত্যুর ৩২ শতাংশ হয়ে থাকে হৃদরোগ এবং রক্তনালির রোগের কারণে। তারা বলেন, উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা না হলে বুকে ব্যথা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইল এবং হার্ট বিট অনিয়মিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। হৃদরোগের কারণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা নিয়ে আজ আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ। তিনি কুমিল্লার ময়নামতি মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ।

 

# স্বাস্থ্য প্রতিবেদন

ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্তের শীর্ষে পুরুষ, স্তন ক্যান্সারে নারী

 

সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সম্প্রতি জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যায়, হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা পুরুষ রোগীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ফুসফুস ক্যান্সারে।  ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে আসা রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে জানানো হয়, শতকরা বিবেচনায় প্রায় ২৬ শতাংশ পুরুষ রোগীর ফুসফুর ক্যান্সার রয়েছে। আর ২৯ শতাংশ নারী স্তন ক্যান্সারে ভুগছেন।

অনুষ্ঠানে এসব তথ্য উপস্থাপন করেন ইনস্টিটিউটের ক্যান্সার ইপিডেমিওলোজি বিভাগের সদ্য-সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা.  হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।

তিনি জানান, ২০১৮-২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন বছরে জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালে সব মিলিয়ে রোগী এসেছেন প্রায় ৮৪ হাজার, যাদের মধ্যে ৩৫ হাজারেরও বেশি রোগীর ক্যান্সার ধরা পড়েছে।

স্বাস্থ্যবিদদের মতে, ধূমপানসহ নানা অভ্যাসের কারণে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। পাশাপাশি এটি নিযন্ত্রণে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নীতি-নির্ধারকদের বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কোন ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য ও কোনটি চিকিৎসা ছাড়া হবে না সেটি নির্ণয় করতে হবে। একই সঙ্গে পৃথক লিঙ্গ ও বয়সকে গুরুত্ব দিতে হবে। কোন বয়সে কোন ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে সেটিও দেখতে হবে।

ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধের বিকল্প নেই জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, পরিবেশ ও খাদ্যাভাসও ক্যান্সারের বড় একটি কারণ। কয়েক বছর আগেও এটি নিয়ে কাজ করা অতটা সহজ ছিল না। চিকিৎসা ব্যবস্থাও উন্নত ছিলো না। এখন পরিবর্তন আসলেও রয়ে গেছে ঘাটতি। তাই অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ইনস্টিটিউট নির্মাণের উপর জোর দেন তারা।

 

অভি/রহমান

 

##কী_খাবো_কী_খাবো_না

রোগের বিরুদ্ধে লড়ার জাদুকরী ক্ষমতা রয়েছে মধুর

পুষ্টিগুণ বিবেচনায় প্রথম সারিতেই থাকবে মধুর নাম। এটি শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী। নিয়মিত মধু সেবন করলে মুক্তি পাওয়া যায় অসংখ্য রোগবালাই থেকে। এ বিষয়টি এখন বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত। 

মধুর উপাদান:

মধুতে থাকে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান। ১০০ গ্রাম মধুতে থাকে ২৮৮ ক্যালরি। ফুলের পরাগের মধুতে থাকে ২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ গ্লুকোজ, ৩৪ থেকে ৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ। আছে অ্যামাইনো অ্যাসিড, খনিজ লবণ এবং এনকাইম। এতে চর্বি ও প্রোটিন নেই।

রুপচর্চায় মধুর উপকারিতা:

মেয়েদের রূপচর্চার ক্ষেত্রে মাস্ক হিসেবে মধুর ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। মুখের ত্বকের মসৃণতা বৃদ্ধির জন্যও মধু ব্যবহৃত হয়। মধুতে থাকা অ্যান্টি-সেপ্টিক উপাদান ব্রণের জন্য দায়ী জীবানু দূর করে ত্বককে রাখে সতেজ ও সুন্দর। এছাড়া ত্বকের লোমকূপের ভেতরে থাকা ময়লা দূর করতে সাহায্য করে মধু। চাইলে ছেলেরাও মধু ব্যবহার করতে পারেন। যাদের ত্বকে অতিরিক্ত তেল রয়েছে তাদের জন্য মধু ভীষণ কার্যকর। মধুতে থাকা অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান ত্বকের হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনে। ত্বকের ভাঁজ পড়া ও বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে মধু। সব মিলিয়ে তারুণ্য ধরে রাখতে মধুর ব্যবহার হয় বিশ্বজুড়েই।

দাঁতে মধুর ব্যবহার:

দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায় দুর্দান্ত কাজ করে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপহার মধু। এটা দাঁতের ওপর ব্যবহার করলে দাঁতের ক্ষয়রোধ করে। দাঁতে পাথর জমাট বাঁধা রোধ করে এবং একইসঙ্গে দাঁত পড়ে যাওয়া বিলম্বিত করে। মধু রক্তনালিকে সম্প্রসারিত করে রক্ষা করে মাড়ির স্বাস্থ্য। মধু মিশ্রিত পানি দিয়ে গড়গড়া করলে দূর হবে মাড়ির জ্বালাপোড়া। যদি মুখে কোন রকম ঘা হয় এবং এ কারণে যদি গর্ত হয়, এটি সেই গর্ত ভরাট করতে সাহায্য করে মধু। সেখানে পুঁজ জমতে দেয় না। তাই মুখের ভেতরটাও সুন্দর ও সুস্থ রাখতে শুরু করতে পারেন মধুর ব্যবহার।

শক্তির ভালো উৎস মধু: মধু ভালো শক্তি প্রদায়ী খাদ্য। তাপ ও শক্তির ভালো উৎস। মধু দেহে তাপ ও শক্তি জুগিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে।

হজমে সহায়তা করে মধু: এতে যে শর্করা থাকে, তা সহজেই হজম হয়। কারণ, এতে যে ডেক্সট্রিন থাকে, তা সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ক্রিয়া করে। পেটরোগা মানুষের জন্য মধু বিশেষ উপকারী।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে দারুণ কার্যকর মধু: এতে রয়েছে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স। এটি ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ১ চা চামচ মধু ভোরবেলা পান করলে এ সমস্যা থেকে দ্রুতই মুক্তি পাবেন। আর ডায়রিয়া হলে এক লিটার পানিতে ৫০ মিলিলিটার মধু মিশিয়ে খেলে দেহে পানিশূন্যতা রোধ করা যায়। এছাড়া পুরোনো আমাশয় এবং পেটের পীড়া নিরাময়সহ নানাবিধ জটিল রোগের উপকার করে থাকে।

রক্তশূন্যতা রোধে মধুর ভূমিকা: মধু রক্তের হিমোগ্লোবিন গঠনে সহায়তা করে বলে এটি রক্তশূন্যতায় বেশ ফলদায়ক। কারণ, এতে থাকে খুব বেশি পরিমাণে কপার, লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ।

ফুসফুসের যাবতীয় রোগ ও শ্বাসকষ্ট নিরাময়ে: বলা হয়, ফুসফুসের যাবতীয় রোগে মধু উপকারী। যদি একজন অ্যাজমা বা শাসকষ্টের রোগীর নাকের কাছে মধু ধরে শ্বাস টেনে নেওয়া হয়, তাহলে সে স্বাভাবিক এবং গভীরভাবে শ্বাস টেনে নিতে পারবে। অনেকে মনে করে, এক বছরের পুরোনো মধু শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য বেশ ভালো। আধা গ্রাম গুঁড়ো করা গোলমরিচের সঙ্গে সমপরিমাণ মধু এবং আদা মেশান। দিনে অন্তত তিনবার এই মিশ্রণ খান। এটা হাঁপানি রোধে সহায়তা করে।

অনিদ্রা দূর করে মধু: মধু অনিদ্রার ভালো ওষুধ। রাতে শোয়ার আগে এক গ্লাস পানির সঙ্গে দুই চা চামচ মধু মিশিয়ে খেলে এটি গভীর ঘুম ও সম্মোহনের কাজ করে।

দাম্পত্য জীবনকে মধুর করবে মধু: যাঁদের শারিরীক দুর্বলতা রয়েছে, তাঁরা যদি প্রতিদিন মধু ও ছোলা মিশিয়ে খান, বেশ উপকার পাবেন পাবেন। সুখ সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে আপনার দাম্পত্য জীবন।

মধু প্রশান্তিদায়ক পানীয়: হালকা গরম দুধের সঙ্গে সামান্য মধু মিশিয়ে খেলে শরীরের একরকম প্রশান্তি অনুভব করবেন আপনি।

পাকস্থলীর সুস্থতায় মধু: মধু পাকস্থলীর কাজকে জোরালো করে এবং হজমের গোলমাল দূর করে। এর ব্যবহার হাইড্রোক্রলিক অ্যাসিড ক্ষরণ কমিয়ে দেয় বলে অরুচি, বমিভাব, বুকজ্বালা এগুলো দূর করা সম্ভব হয়।

শরীর সতেজ রাখে মধু: শীতের ঠান্ডায় এটি শরীরকে গরম রাখে। এক অথবা দুই চা–চামচ মধু এক কাপ ফুটানো পানির সঙ্গে খেলে শরীর ঝরঝরে ও সতেজ থাকে। এছাড়া গলার স্বর সুন্দর ও মধুর করে মধু।

মধু দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়: চোখের জন্যেও ভালো কাজ করে মধু। গাজরের রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে দৃষ্টিশক্তি বাড়ে।

ওজন কমাতে দুর্দান্ত কাজ করে মধু: মধুতে নেই কোনো চর্বি। পেট পরিষ্কার করে, চর্বি কমায়, ফলে ওজন কমে। মধু প্রাকৃতিকভাবেই মিষ্টি। তাই মধু সহজে হজম হয় এবং হজমে সহায়তা করে।

হাড় ও দাঁত গঠনে মধু: মধুর গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ক্যালসিয়াম। ক্যালসিয়াম দাঁত, হাড়, চুলের গোড়া শক্ত রাখে, নখের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করে, ভঙ্গুরতা রোধ করে।

মধু উচ্চ রক্তচাপ কমায়: দুই চামচ মধুর সঙ্গে এক চামচ রসুনের রস মেশান। সকাল-সন্ধ্যা দুইবার এই মিশ্রণ খান। প্রতিনিয়ত এটার ব্যবহার উচ্চ রক্তচাপ কমায়। প্রতিদিন সকালে খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে খাওয়া উচিত।

রক্ত পরিষ্কারেও শক্তিশালী মধু: এক গ্লাস গরম পানির সঙ্গে এক বা দুই চামচ মধু ও এক চামচ লেবুর রস মেশান। পেট খালি করার আগে প্রতিদিন এটি খান। এটা রক্ত পরিষ্কার করতে ভীষণ সাহায্য করে। তা ছাড়া রক্তনালিগুলোও পরিষ্কার করে। রক্ত উৎপাদনকারী আয়রন রয়েছে মধুতে। রক্তের উপাদান আরবিসি, ডব্লিউবিসি ও প্লাটিলেটকে কার্যকর ও শক্তিশালী করতে পারে মধু।

হৃদ্‌রোগকেও দূর রাখে মধু: এক চামচ মৌরি গুঁড়োর সঙ্গে এক বা দুই চামচ মধুর মিশ্রণ হৃদ্‌রোগের টনিক হিসেবে কাজ করে। এটা হৃৎপেশিকে সবল করে এবং এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

রোগের বিরুদ্ধে লড়তে শক্তি জোগায় মধু: শরীরের রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়িয়ে ,শরীরের ভেতরে এবং বাইরে যেকোনো ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা রয়েছে মধুর। মধুতে আছে একধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধকারী উপাদান, যা অনাকাঙ্ক্ষিত সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে আপনাকে।

তাই নিয়মিত মধু খাওয়ার অভ্যেস করুন। প্রাকৃতিকভাবেই দূরে রাখুন জটিল সব রোগবালাই।  - হাবিবুর রহমান অভি/ রহমান [কৃতজ্ঞতা: ইশরাত জাহান, পুষ্টিবিদ]

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।