চীনের আধুনিকায়নের অনিবার্য পথ সবুজ-উন্নয়ন দর্শন
2022-12-04 20:01:13

২০১২ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিসির ১২তম কংগ্রেসের পর চীন একটি নতুন উন্নয়ন-দর্শন গ্রহণ করে।  এ উন্নয়ন-দর্শনের মূলে রয়েছে উদ্ভাবনমুখি, সমন্বিত, সবুজ, উন্মুক্ত ও অভিন্ন উন্নয়ন। গত এক দশকে চীন তার এ নতুন উন্নয়ন-কাঠামোয় দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করেছে। গত ২৬ অক্টোবর সিপিসির ২০তম কংগ্রেসেও সবুজ উন্নয়নকে চীনের আধুনিকায়নের অনিবার্য পথ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং নতুন কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে।

ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গত ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় ইংরেজি জাতীয় দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্রান্ডার্ডে এ বিষয়টি নিয়ে একটি তথ্যসমৃদ্ধ ও বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ লিখেছেন।

‘অ্যা গ্রিনার ডেভেলপমেন্ট প্লিজেস’ শীর্ষক নিবন্ধে চীনা রাষ্ট্রদূত সিপিসির ১৮তম জাতীয় কংগ্রেস থেকে শুরু করে গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ২০তম কংগ্রেসের সবুজ উন্নয়নে বিষয়ে চীনের গৃহীত বিভিন্ন নীতি ও কর্মপরিকল্পনা নানা উদাহরণ সহযোগে তুলে ধরেছেন এবং ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমায় সিপিসি কংগ্রেসের নির্দেশনার বিষয়টিও ব্যাখ্যা করেছেন।

আজকের সংবাদ পর্যালোচনায় আমরা নজর দেবে এ বিষয়টির দিকে।

রাষ্ট্রদূত লি জিমিং তাঁর নিবন্ধের শুরুতেই নিকট অতীতের স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, একসময় উত্তরচীনে বায়ুদূষণ খুবই গুরুতর অবস্থায় পৌঁছেছিল এবং সেটি প্রায়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হতো।

কিন্তু এখন দৃশ্যপট একেবারেই বদলে গেছে। এখন আর চীনের বায়ুদূষণের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয় না বরং চীন এখন পরিবেশবান্ধব সবুজ-উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়ন করছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বৈশ্বিক আন্দোলনে চীন এখন অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করছে।

রাষ্ট্রদূত লি জিমিং চীনের এ অভাবিত পরিবর্তনের পিছনে অনুঘটক, কীভাবে চীন এ পরিবর্তন ঘটালো এবং ভবিষ্যতে কোন পথে চলবে তার একটি সুন্দর বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন তার নিবন্ধে।

লি জিমিং চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘স্বচ্ছ জল আর মনোরম পর্বতমালা’ আমাদের অমূল্য সম্পদ। অর্থাৎ উন্নয়নের বিনিময়ে এ অমূল্য সম্পদ নষ্ট করা যায় না। পরিবেশের বিনিময়ে উন্নয়ন টেকসই হয় না। প্রকৃতির সঙ্গে, পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলাটাই মৌলিক বিষয়।

রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলছেন, ১৮তম কংগ্রেসে চীন যে নতুন উন্নয়ন দর্শন গ্রহণ করে তাতে মানসিকতার পরিবর্তন আসে এবং এতে কর্মউদ্যোগেও পরিবর্তন সাধিত হয়। এর ফলেই চীন সবুজ-উন্নয়নের পথে লক্ষ্যণীয় অগ্রগতি অর্জন করে।

গত এক দশকে চীন পরিবেশগত উন্নয়নে সামগ্রিক ও পদ্ধতিগত উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে পাহাড়, বন, পানি, কৃষিভূমি, তৃণভূমি, জলাভূমি ও মরুভূমির পরিবেশগত উন্নয়নে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করে। ঐতিহাসিক ও সংস্কারমূলক এ কাজের ফলে চীন নীল আকাশ, সবুজ পাহাড় আর স্বচ্ছ পানি ফিরে পেয়েছে।

লি জিমিং উদাহরণ দিয়ে বলছেন, চীনের নতুন বনায়ন বিশ্বের একচতুর্থাংশ। প্রতি ইউনিট জিডিপিতে কার্বন নিঃসরণ কমেছে ৩৪.৪ শতাংশ। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ৬৮.৫ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৫৬ শতাংশ। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহারেও চীন বিশ্বে প্রথম স্থানে। নতুন-জ্বালানির গাড়ি উৎপাদনে ও বিক্রিতেও শীর্ষে চীন।

প্যারিস জলবায়ু চুক্তির অন্যতম পক্ষ হিসেবে চীন ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে। রাজনৈতিক কিংবা জ্বালানি সংকটের কারণে অন্য অনেক দেশ তাদের অবস্থান থেকে পিঁছু হটলেও চীন এখনো তার অঙ্গীকারে অটল রয়েছে।

রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, গত অক্টোবরে সিপিসির ২০তম কংগ্রেসেও সবুজ-উন্নয়নকে চীনের আধুনিকায়নের অনিবার্য পথ বলে গ্রহণ করা হয়েছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে পরিবেশবান্ধব জীবন-জীবিকা, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস আর পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে একটি ‘সুন্দর চীন’ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে সিপিসির প্রতিবেদনে।

এ লক্ষ্য অর্জনে কয়েকটি ধাপের কথা উল্লেখ করেছেন লি জিমিং।

প্রথমত: শিল্পকাঠামো ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় সুসমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন, সবুজ ও নিম্নকার্বন নির্গমণকারী শিল্পকারখানা গড়ে তোলা।

দ্বিতীয়ত: আইনসিদ্ধ, লক্ষ্যাভিসারি ও বৈজ্ঞানিক ওপায়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শহর ও গ্রামাঞ্চলে জীবনযাত্রার উন্নয়ন।

তৃতীয়ত: প্রধান প্রধান ইকো-সিস্টেম সংরক্ষণ ও পুনর্বহালের মাধ্যমে পরিবেশগত বৈচিত্র রক্ষা, স্থিতিশীল ও টেকসই করা।

চতুর্থত: কার্বন লক্ষ্য অর্জনে সক্রিয়ভাবে কাজ করা। জ্বালানি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ বিশেষ করে জীবাস্মজ্বালানি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা।

এ লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ চীনের সহযোগি হতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিনি উল্লেখ করেন বাংলাদেশও পরিবেশগত বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির অন্যতম শিকার। তবে বাংলাদেশ এ বিষয়ে সচেতন হয়ে পরিবেশ রক্ষায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বিশেষ করে তিনি ২০২০ সালে গৃহীত মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যানের কথা উল্লেখ করেন নিবন্ধে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘের সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ স্বীকৃতি লাভের কথাও উল্লেখ করেন চীনা রাষ্ট্রদূত।

সবুজ-উন্নয়ন দর্শনে বাংলাদেশ ও চীন একযোগে কাজ করে একটি অভিন্ন ভবিষ্যতের মানব সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারে- সে সম্ভাবনার কাথাও নিবন্ধে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।