দুই বোনের মূক-বধির কফি দোকান
2022-12-02 11:58:22

নিজের একটি দোকান চালু করা হয়তো অনেকের একটি স্বপ্ন। তবে মূক-বধির মানুষের জন্য তা বেশ কঠিন কাজ। তা হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আমাদের কাছে সহজ ব্যাপার হলেও তাদের কাছে দশ গুণ কঠিন হতে পারে। সম্প্রতি চীনের সু চৌ শহরে এমন দু’জন বোন ‘মূক-বধির’ কফি দোকান খুলেছেন। আজ আপনাদেরকে সে গল্প জানাবো।

সু চৌ শহরে নতুন খোলা এই বিশেষ ‘মূক-বধির’ কফি দোকানে কর্মীরা সাংকেতিক ভাষায় কথাবার্তা বলেন। দোকানের মালিক হলেন ২৮ বয়স বয়সী মেয়ে ইয়ান ইং ফেং এবং ইয়ান ইং খাই। তারা দু’জনই যমজ বোন। জন্ম থেকেই তাঁদের শোনার সমস্যা আছে। তবে, দু’জনেরই ছবি আঁকার প্রতিভা রয়েছে। নিজের চেষ্টায় তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছেন এবং স্নাতক পাশের পর স্থানীয় প্রতিবন্ধী কমিশন ও অন্যের সাহায্যে তাঁরা এই কফির দোকান খুলেছেন।

 

দোকানে ঢুকে দেখা যায়, দোকানটি অনেক উজ্জ্বল এবং প্রশস্ত, হলুদ রংয়ের সাজ-সজ্জা মানুষকে উষ্ণ অনুভূতি দেয়। দোকানটি খুব শান্ত-নীরব, শুধু কফি বানানোর শব্দ শোনা যায়। যদিও এটি একটি নতুন দোকান, তারপরও প্রতিদিন অনেক ক্রেতা এখানে আসেন।

এখানে অর্ডার দিতে ক্রেতারা স্মার্ট ভয়েস যন্ত্রের দিকে নিজের অর্ডারের বিস্তারিত তথ্য দেন। যেমন ক্রেতা যন্ত্রের দিকে বলেন, কফি দুটো, মিডল কাপ, গরম’। দোকান কর্মীরা দ্রুত সেই তথ্য পেয়ে কফি তৈরি শুরু করেন। এভাবে অর্ডার নেওয়া সহজ হয়।

যমজ দুই বোন এই দোকানের মালিক। তাঁরা প্রধানত কফি দোকানটি পরিচালনার কাজ করেন। প্রথমবার দোকানে আসা ক্রেতাদের সুবিধার জন্য বোনেরা অর্ডার দেয়ার সংশ্লিষ্ট সাংকেতিক ভাষার কার্ড তৈরি করেন এবং দোকানে কিছু সহজ গেমের ব্যবস্থা রেখেছেন।

একজন ক্রেতা জানান, তিনি এই দোকানে অনেক বার এসেছেন। কর্মীদের সেবা অনেক ভালো। স্মার্ট যন্ত্রপাতি আছে, লেখার বোর্ড আছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই।

দোকান মালিক ইয়ান ইং ফেং সাংকেতিক ভাষায় বলেন, অনেক ক্রেতার পছন্দ দেখে তিনি মনে অনেক উষ্ণতা পেয়েছেন। তিনি এতে খুব খুশি। তিনি মনে করেন, কফি বানানো অনেক তাত্পর্যপূর্ণ ব্যাপার হয়ে উঠেছে।

 

১৯৯৪ সালে ইয়ান ইং ফেং এবং ইয়ান ইং খাই-এর জন্ম হয়। তবে বাবা মা আবিষ্কার করেন যে, বোনেরা বাইরের শব্দের কোনো সারা দিতে পারে না। ডাক্তারের পরীক্ষার পর জানিয়েছে যে, তাদের শোনার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্সা করলেও এর সমাধান হয় নি। জন্ম থেকেই তাদের বিশ্ব হল নিশ্চুপ-নির্বাক!

ইয়ান ইং ফেং স্মরণ করে বলেন, ছোটবেলায় তিনি এবং ছোট বোন আত্মগ্লানিতে ভুগতেন। তারা কথা বলতে পারতেন না দেখে অনেকেই তাদের সঙ্গে খেলতো না। যদিও শোনা যায় না, তবে তারা ছবি আঁকায় বেশ দক্ষ ছিল। বাবা মা তাদের খুব সমর্থন করত এবং সাহায্য করত। বোনেরা ছবি আঁকতে অনেক আনন্দ পেত।

২০১৫ সালে ইয়ান ইং ফেং এবং ইয়ান ইং খাই তাদের স্বপ্ন পূরণের পথে পা ফেলেন। তারা বেইজিংয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁদের প্রথম চাকরি হল একটি মুভি কোম্পানিতে কাজ করা। সাধারণত তাঁরা বাসা থেকে কাজ করতেন। তাই তাঁরা খুব কমই বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।

 

তিন বছর আগে স্থানীয় প্রতিবন্ধী কমিশনের সাহায্যে তাঁরা এক প্রতিবন্ধী সংস্থায় গিয়ে ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন এবং নির্বাক কফি দোকান প্রকল্পে অংশ নেন। এই প্রকল্পটি হল স্থানীয় শ্রমিক কমিশনের উদ্যোগে প্রতিবন্ধীদের সাহায্যকারী প্রকল্প। প্রতিবন্ধী যদি নিজেই কাজ করতে চান, তাহলে দোকান ভাড়ার ফি, বিদ্যুত্ ও পানির ফি মওকুফ করা হয়।

২০২১ সালের জুলাই মাসে স্থানীয় থাই ছাং শহরের প্রতিবন্ধী কমিশনের সাহায্যে ইয়ান ইং ফেং এবং ইয়ান ইং খাই নির্বাক কফি দোকান চালু করেন এবং পরিচালনার  দায়িত্ব পালন করেন।

ইয়ান ইং খাই জানান, শুরুর দিকে তাঁরা প্রতিদিন কাজ শেষে শিক্ষকের কাছ থেকে কফি বানানের কৌশল শিখতেন। আসলে তা কল্পনার চেয়েও অনেক কঠিন ছিল। সাধারণত মানুষ মিল্ক ফ্রোথার মেশিনের শব্দ শুনে গরম দুধের অবস্থা বুঝতো। তবে বধির মানুষ শুধু হাত দিয়ে তাপ অনুভব করতে পারেন, চোখ দিয়ে দুধের অবস্থা যাচাই করতে পারেন।

 

যত কঠিন হোক-না-কেন, বোনেরা হাল ছেড়ে দেন নি। কফি দোকানের ব্যবসা আস্তে আস্তে ভালো হতে থাকে। ক্রেতারা তাদের গল্প শুনে কফি কিনে তাদের প্রতি সমর্থন জানান। প্রতিবন্ধী কমিশন ও সমাজের বিভিন্ন মহলের সাহায্যে থাই ছাং শহরে তিনটি নির্বাক কফি দোকান বসানো হয়।

বোন ইয়ানের এই দোকানে এখন তিনজন কর্মী আছেন। তাদের মধ্যে দু’জন বধির, দু’জন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, চারজন দৈহিক প্রতিবন্ধী। বর্তমানে নির্বাক কফি দোকান প্রকল্প ইতোমধ্যে ৩ জনেরও বেশি প্রতিবন্ধীকে সাহায্য করেছে।

বোন ইয়ান জানান, তাঁরা ভালোভাবে এই কফি দোকান পরিচালনা করবেন, যাতে ভবিষ্যতে আরো বেশি প্রতিবন্ধীর কর্মসংস্থান তৈরি সাহায্য করা যায়।

 

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং একবার বলেছিলেন, প্রতিবন্ধীরা এক বিশেষ গোষ্ঠী, তাদের প্রতি অনেক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ব্যাপক প্রতিবন্ধীদের সুন্দর জীবন নিশ্চিত করা হল সিপিসি’র জনগণকে সেবা করার চেতনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যা চীনের সমাজতন্ত্রের ব্যবস্থার প্রতিফলন। ঠিক তাঁর কথামতো, প্রতিবন্ধীরা চমত্কার জীবন অর্জন করতে পারবে। চীনে ব্যাপক প্রতিবন্ধী সরকার ও সমাজের সাহায্যে সুন্দর জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।