মহাকাশে স্বপ্নের অনুসন্ধান
2022-11-25 16:56:12


 

প্রাচীনকাল থেকেই মানবজাতির মহাকাশ সম্বন্ধে জানার অনেক আগ্রহ রয়েছে। এই কারণে অনেক সুন্দর রূপকথার সৃষ্টি হয়েছে। তা মানবজাতির সুন্দর আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এখন মানববাহী মহাকাশ মিশনের মাধ্যমে মানবজাতি মহাকাশ সম্বন্ধে জানতে পারছে। এই সুন্দর মহাকাশে এত অজানার বিষয় আছে, তা সবাইকে অবাক করে। অনেক দেশ মানববাহী মহাকাশ অনুসন্ধানের প্রকল্প গ্রহণ করেছে; তবে, সত্যিকার অর্থে সারা বিশ্বে শুধু তিনটি দেশ তা বাস্তবায়নে সক্ষম হয়েছে। আর চীন এর অন্যতম। তাহলে চীনের মহাকাশ প্রকল্পের উন্নয়নের পথ কি রকম? এর পিছনে কত অজানা গল্প রয়েছে? আজ আমি এই বিষয়ে কথা বলব।

 

মানববাহী মহাকাশ প্রকল্প হল বর্তমানে বিশ্বের প্রযুক্তি খাতে সবচেয়ে জটিল এবং কঠিন প্রকল্প। এই খাতের শক্তি একটি দেশের বিজ্ঞান ও অর্থনীতি খাতের শক্তির প্রতিচ্ছবি।

 

চীনের মানববাহী মহাকাশ প্রকল্প ১৯৯২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় এবং এতে তিন ধাপের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারিত হয়। প্রথম ধাপের পরিকল্পনা হল মানববাহী মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করা, এবং মহাকাশ পরীক্ষা করা। দ্বিতীয় ধাপ হল স্পেস ওয়াকের প্রযুক্তি অর্জন করা, এবং মহাকাশ পরীক্ষা মডিউল উৎক্ষেপণ করা। তৃতীয় ধাপ হল মহাকাশ স্টেশন নির্মাণ করা, এবং বড় আকারের ও দীর্ঘসময় ধরে বিদ্যমান মহাকাশ সমস্যা সমাধান করা।

 

তখন থেকে বংশপরম্পরায় চীনা মহাকাশ কর্মীরা আত্মনির্ভরশীল হয়ে ব্যাপকভাবে মহাকাশ প্রযুক্তি খাতে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছেন এবং নিজস্ব মেধাস্বত্বের প্রযুক্তি অর্জন করেছেন। গত ৩০ বছরে চীন উন্নত দেশের আধা শতাব্দীর সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

 

২০০৩ সালের ১৫ অক্টোবর চীনের প্রথম মানববাহী নভোযান শেনচৌ-৫-এর মাধ্যমে চীনা নভোচারী ইয়াং লি ওয়েই সাফল্যের সঙ্গে মহাকাশে পৌঁছান। মোট ২১ ঘণ্টা ২৩ মিনিট পর নির্ধারিত কক্ষপথে ১৪ বার ঘুরার পর নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। চীন এর মাধ্যমে বিশ্বে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর ক্ষেত্রে তৃতীয় দেশ হয়েছে।

 

আসলে তা বহু বছর স্থায়ী এক কঠিন যাত্রা।

 

১৯৫৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে মানবজাতির জন্য মহাকাশকে অনুসন্ধানের যুগ উন্মোচন করেছে। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন মানবজাতির প্রথম মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন। একই বছরের ৫ মে মার্কিন নভোচারী অ্যালান বার্টলেট শেপার্ড মহাকাশে ১৫ মিনিট থাকেন, তিনি মানবজাতির ইতিহাসে দ্বিতীয় মহাকাশে পৌঁছা ব্যক্তি।

 

এমন অবস্থা দেখে তৎকালীন চীনের প্রেসিডেন্ট মাও সে তুং বলেন, তাহলে আমাদেরকে কীভাবে শক্তিশালী দেশ বলা যায়; আমরাতো এখনও মহাকাশে একটি আলুও পাঠাতে পারিনি।

 

বিংশ শতাব্দীর ৭০-এর দশকের শুরুর দিকে চীনের মানববাহী মহাকাশ প্রকল্পের গবেষণা শুরু হয়। এই প্রকল্পকে ‘৭১৪’ প্রকল্প নাম দেয়া হয়। কারণ তা ১৯৭১ সালের এপ্রিলে উত্থাপিত হয়। এরপর ২০  বছরে চীনের স্পেস প্রযুক্তির টেকসই উন্নতি হয়। তবে, এটি একটি জটিল ও কঠিন প্রকল্প।

 

বিদেশের মানববাহী মহাকাশ গবেষণা ইতিহাস থেকে জানা যায়, জিডিপিতে এর ব্যয়ের হার হিসেবে মানববাহী প্রকল্প হল ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প, তা পিরামিড, মহাপ্রাচীর এবং বিভিন্ন যুগের মহান প্রকল্পের চেয়ে মূলবান। চীনের মহাকাশ প্রকল্প কার্যালয় প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রকল্প চালু থেকে ২০০৫ সালের শেনচৌ-৬ নভোযান উৎক্ষেপণ পর্যন্ত তথা চীনের মানববাহী প্রকল্পের প্রথম ধাপ সম্পন্ন পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে ২০ বিলিয়ন ইউয়ান।

 

এটি একই সঙ্গে একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প। ‘আকাশে যাওয়া’ হল এই বিশ্বে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের অন্যতম। এতে বিভিন্ন যুগের সবচেয়ে নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। পরিবাহক রকেট, মানববাহী নভোযান, উড়োজাহাজের কাঠামো অনেক জটিল, খুচরা যন্ত্রাংশের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। একটি যন্ত্রাংশ উৎকর্ষ না হলে দুর্ঘটনা সৃষ্ট হবে।

 

মহাকাশ স্টেশন নির্মাণ করা হল চীনের মহাকাশ প্রকল্প উন্নয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। আগের আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটি ১৬টি দেশ ও অঞ্চলের যৌথ নির্মিত। এই লম্বা তালিকায় উন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশও আছে। তবে, চীনের নাম ছিল না। কিছু কিছু দেশ চীনকে অবরুদ্ধ করে, চীনের উন্নয়নকে প্রতিরোধ করে, এবং চীনকে বিশ্বের মহাকাশ স্টেশন ক্লাবের বাইরে রাখতে চেয়েছিল।

 

তবে, চীনা মহাকাশ প্রকল্প কর্মীরা কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়নি। গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি কেনা যায় না। চীন নিজের মানববাহী প্রকল্প উন্নয়ন করতে নিজস্ব উদ্ভাবনের পথে এগিয়ে যায়।

 

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছিলেন, মহাকাশের স্বপ্ন হল দেশকে শক্তিশালী করার স্বপ্নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অসীম মহাবিশ্বে অনুসন্ধান করা, চীনের মহাকাশ-সংক্রান্ত গবেষণা উন্নত করা, মহাকাশ খাতের শক্তিশালী দেশ গঠন করা হল চীনের মহাকাশ খাতের স্বপ্ন।

 

এখন মহাকাশে চীনের শেনচৌ-১৪ করে চারজন নভোচারী ছয় মাসের কর্তব্য পালন করছেন। অদূর ভবিষ্যতে আরও বেশি নভোচারী চীনের মহাকাশ স্টেশনে প্রবেশ করবেন, আরও বেশি কাজ করবেন। আগামী বছর চীনের তৃতীয় দফার নভোচারীরা যথাক্রমে মহাকাশে যাবেন, চতুর্থ দফার নভোচারীদের নির্বাচন শুরু হয়েছে। এতে ১২ থেকে ১৪ জন নভোচারী নির্বাচিত হবেন।

 

মহাকাশ খাতের অগ্রগতি চীনের বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের প্রতিফলন। চীন মানববাহী মহাকাশ কাজ উন্নয়নে সবসময় শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, সমান ও পারস্পরিক উপকারিতা, যৌথ উন্নয়নের নীতি অনুসরণ করে চলে। চীন ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, রাশিয়া ও পাকিস্তান এবং জাতিসংঘের মহাকাশ বিভাগ, ইউরোপের মহাকাশ ব্যুরোসহ বেশ কিছু মহাকাশ সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে নানাভাবে সহযোগিতা প্রকল্প চালু করেছে এবং এসব সহযোগিতা ফলপ্রসূ হয়েছে।

 

চীনের মহাকাশ স্টেশন হল ইতিহাসে প্রথমবারের মত জাতিসংঘের সব সদস্য দেশের জন্য উন্মুক্ত প্রকল্প। বর্তমানে ১৭টি দেশ, ২৩টি গোষ্ঠীর ৯টি প্রকল্প চীনা মহাকাশ স্টেশনের প্রথম দফা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তা মহাকাশ খাতে মানবজাতির অভিন্ন ভাগ্যের কমিউনিটি গড়ে তোলায় চীনের নিরলস চেষ্টার সাক্ষী।

 

মহাকাশ সকল মানবজাতির, তা মানবজাতির কল্যাণের জন্য ব্যবহৃত হওয়া উচিত। বিশ্বাস করি, অদূর ভবিষ্যতে চীনা মহাকাশ স্টেশন গোটা মানবজাতির মহাকাশ অনুসন্ধানের ‘নতুন বাড়ি’ হবে।