নভেম্বর ২২: তুমুল তর্ক-বিতর্কের পর ‘জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন কাঠামো কনভেনশন’-এর ২৭তম স্বাক্ষরকারী দেশের সম্মেলন তথা কপ-২৭ গত রোববার মিসরের শার্ম এল শীকে সমাপ্ত হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৩৬ ঘন্টা বেশি স্থায়ী হয় সম্মেলন। এতে বেশকিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে মনোযোগ পাওয়া বিষয় হলো ক্ষতিপূরণ তহবিল স্থাপিত হওয়া। এই তহবিলের উদ্দেশ, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল ও দুর্বল দেশগুলোকে সাহায্য করা।
কপ-২৭ থেকে পাওয়া ফলাফল অর্জন সহজ ব্যাপার ছিল না। কারণ, এখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জরুরি চাহিদার কথা বলা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা একটি ঐতিহাসিক অগ্রগতি। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরহিসও এক বিবৃতিতে বলেছেন, সম্মেলনে ন্যায্যতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিওয়া হয়েছে।
চলতি বছর হচ্ছে ‘জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন কাঠামোগত কনভেনশন’ স্বাক্ষরের ৩০তম বার্ষিকী এবং ‘প্যারিস চুক্তি’ বাস্তবায়নের নিয়ম প্রণয়নের প্রথম বছর। তবে, মানবজাতির সামনে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ দিন দিন কঠোর থেকে কঠোরতর হচ্ছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মে মাসের প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, সমুদ্রের তাপ এবং সমুদ্রের অম্লকরণ—এই চার সূচক ইতিহাসের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়। গত জুন মাসে পাকিস্তানে অভূতপূর্ব বন্যায় কোটি কোটি লোক দুর্যোগকবলিত হয়, যার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এমন প্রেক্ষাপটে কপ-২৭-এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল: ‘বাস্তবায়ন’। মানে, বিভিন্ন পক্ষের উচিত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোকে দেয় প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের দায় মূলত উন্নত দেশগুলোর। তবে, এতে সৃষ্ট অধিকাংশ ক্ষয়ক্ষতি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বহন করতে হচ্ছে, যা কোনো অবস্থাতেই যুক্তিযুক্ত নয়। তাই উন্নত দেশগুলোর উচিত ‘অভিন্ন তবে আলাদা দায়িত্ব’ বহন করা, সবার আগে নির্গমন কমানোর দায়িত্ব বাস্তবায়ন করা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
২০০৯ সালের কোপেনহেগেন জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করার খাতে ব্যয় করা হবে। সেই প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি। তাই এবারের কপ-২৭ সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দেওয়া উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি পূরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
এমন পরিস্থিতিতে, উন্নত দেশগুলো অবশেষে ক্ষতিপূরণ তহবিল স্থাপনের ব্যাপারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে একমত হয়েছে। তবে, মনে রাখতে হবে যে, এটা কোনো দয়া নয়, বরং দায়।
পাশাপাশি দেখতে হবে, কপ-২৭ এখনও তহবিলের প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো রোডম্যাপ তৈরি করেনি। কোন কোন দেশ তহবিলে অর্থ দেবে, তহবিল কিভাবে পরিচালিত হবে—ইত্যাদি বিষয়ে কোনো বিস্তারিত সিদ্ধান্ত হয়নি। এর সঙ্গে উন্নত দেশগুলো এই কাজের ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহী নয়। তাই, এই তহবিল ভালোভাবে কাজ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে অনেকের।
বৃহত্তম উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে, চীন সবসময় জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় ব্যবস্থা নিয়ে আসছে। ২০১২ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চীন প্রতিবছর গড়ে ৩ শতাংশ জ্বালানি ভোগের মাধ্যমে বছরে গড়ে ৬.৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাস্তবায়ন করছে। ২০২১ সালে চীনের কার্বন ডাইঅক্সাইট নির্গমন ২০১২ সালের তুলনায় ৩৪.৪ শতাংশ কমেছে, যা ৩.৭ বিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইটের সমান। চীনে পুণর্ব্যবহার্য জ্বালানিতে বরাদ্দ ৩৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ।
এবারের সম্মেলনে চীনা প্রতিনিধিদল সার্বিক ও গভীরভাবে শতাধিক আলোচ্য বিষয়ে অংশ নিয়েছে। দৃঢ়ভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিন্ন স্বার্থ রক্ষা করছে চীন। এ ছাড়া, সম্মেলনে সুফল অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
কোনো কোনো দেশ যেখানে সংঘাতে লিপ্ত, জ্বালানি সংকট যখন বিশ্বব্যাপী, তখন চীন স্থায়ীভাবে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। চীনা প্রতিনিধি বলেছেন, চীনের সরকার ২০২০ সালে নির্গমন কমানোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ভিত্তিতে, ২০৩০ সালের আগে ‘সর্বোচ্চ নির্গমন’ ও ২০৬০ সালের আগে ‘কার্বন-নিরপেক্ষতা’ অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওয়ালস্ট্রিটের খবর অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় চীনের কার্যকর ব্যবস্থা প্রতিশ্রুতির চেয়েও ভালো। (শুয়েই/আলিম/আকাশ)