শিক্ষকের বিয়েতে কিন্ডারগার্টেনের শিশুদের বিশেষ উপহার ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
2022-11-21 12:34:47

আমাদের আসরে চীনের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গল্প তুলে ধরবো। তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা, তাদের গবেষণার সাফল্য, এবং দেশের উন্নয়নের জন্য তাদের অবদানসহ বিভিন্ন বিষয় আজকের আসরে উঠে আসবে। সে হিসেবে আজকের আসর একটু আলাদা। আমরা কয়েকটি চমত্কার গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। এর মধ্যে থাকতে শিক্ষকের বিয়েতে কিন্ডারগার্টেনের শিশু-শিক্ষার্থীদের উপহার দেওয়ার গল্পও। আরও আছে চীনা কিশোর-কিশোরীদের অপেরা শেখার অভিজ্ঞতা এবং অটিজম রোগে আক্রান্ত বাচ্চাদের প্রশিক্ষণে শিক্ষকের নিরলস প্রচেষ্টার কাহিনী। চলুন, মূল আসরে যাওয়া যাক।

ছেন তুং চীনের চিয়াংসু প্রদেশের থাইচৌ শহরের সিনছিয়াও কিন্ডারগার্টেনের একমাত্র পুরুষ শিক্ষক। এখানকার শিশু-শিক্ষার্থীরা তাঁকে পছন্দ করে এবং তাকে ‘ছেন বাবা’ বলে ডাকে। সম্প্রতি শিক্ষক ছেন বিয়ে করেছেন। বাচ্চারা এ সুখবর শুনে তাঁর জন্য বিশেষ একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সে এক চমত্কার মনোমুগ্ধকর গল্প।

শিক্ষক ছেন ছুটি নিয়ে জন্মস্থানে যান এবং বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী-ও একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। সেই স্কুলও কিন্ডারগার্টেনের কাছাকাছি অবস্থিত। ছেনের স্ত্রী বিয়ের আগে থেকেই কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের সাথে পরিচিত। তিনি মাঝেমাঝে এখানে এসে বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করতেন। যখন শিক্ষক ছেন বিবাহের জন্য ছুটিতে যান, তখন কোনো কোনো বাচ্চা জানতে চায়: আমাদের ছেন বাবা কোথায় গেছেন? তাঁর বিবাহের খবর শুনে অনেক বাচ্চা বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বিষয়টি নিয়ে বাচ্চাদের পিতামাতারা আলোচনা করে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক ছেনের জন্য আরেকটি বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে বাচ্চারা তাদের প্রিয় শিক্ষকের বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারে। এ পরিকল্পনার কথা শুনে শিক্ষক ছেনও আনন্দের সাথে নিজের সম্মতি দেন। তখন বাচ্চারা তাদের প্রিয় শিক্ষকের জন্য নিজেদের হাতে বিভিন্ন উপহার বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ চীনা ভাষায় ‘সুখ’ অক্ষর লেখে, কেউ গলার মালা ও রিং তৈরি করে, কেউ কেউ আবার নতুন বৌ-কে স্বাগত জানাতে সাইকেলদল গঠন করে। আর এভাবেই একটি বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠানের সফল যাত্রা শুরু হয়।

শিক্ষক ছেনের বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য দুটি ক্লাসের ১০ জন ছেলে ও ১০ জন মেয়ে শিক্ষক ও পিতামাতাদের সাহায্যে সুন্দরভাবে তাদের ক্লাস সাজায়; সাদা দেয়ালে রঙিন বেলুন ঝোলায়; নিজেদের আঁকা ছবি দিয়ে ক্লাসরুম সাজায়। কিন্ডারগার্টেনের মেঝেতে লাল গালিচাও পাতা হয়; খেলার মাঠে নতুন দম্পতির একটি বড় ছবিও স্থান পায়। যদিও এটি কিন্ডারগার্টেনের একটি বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠান, তথাপি চীনাদের সাধারণ বিবাহের অনুষ্ঠানের সকল আচারই এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিক্ষক ছেন  বলেন, “আমার এ বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠান ৪০ জন ছোট বন্ধুর ভালোবাসার নিদর্শন। আমার কাছে এ  অনুষ্ঠানের বিশেষ তাত্পর্য রয়েছে। আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ স্মৃতি হয়ে থাকবে এ অনুষ্ঠান। ”

চীনাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে বরকে নববধূর কাছে যেতে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ বা পরীক্ষা অতিক্রম করে যেতে হয়। বাচ্চারাও শিক্ষক ছেনের জন্য এসব পরীক্ষা আয়োজন করে। এসব পরীক্ষা মধ্যে আছে ফুলত্তয়ালিকে টাকাভর্তি লাল খাম দেওয়া, নববধূর লুকিয়ে রাখা জুতা খুঁজে বের করা, গান ও নৃত্য পরিবেশন করা, ইত্যাদি। বাচ্চাদের যৌথ প্রয়াসে দুই ঘন্টার বিবাহ অনুষ্ঠান শেষ হয়। সেটি শিক্ষক ছেনের জন্য ছিল শ্রেষ্ঠ উপহার এবং বাচ্চাদের জন্য মজার স্মৃতি।

দুটি ক্লাসের বাচ্চারা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করে। তারা নিজেরাই দাওয়াতপত্র তৈরি করে, মিষ্টির ছোট ছোট প্যাকেট বানায়। চীনাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে সবাইকে মিষ্টিমুখ করানোর রেওয়াজ আছে। মিষ্টি প্রেম ও ভালোবাসার প্রতীক। কিন্ডারগার্টেনের প্রেসিডেন্ট ম্যাডাম চৌ সিয়াও হুই বলেন, অনেক আগ্রহ নিয়ে বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাচ্চারা। এ সুযোগে বাচ্চারা চীনা বিবাহ অনুষ্ঠানের রীতিনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেককিছু জেনেছে ও শিখেছে। ব্যাপারটা বেশ মজার ও তাত্পর্যপূর্ণ।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর চীনা অপেরায় অভিনয় ও ইন্টারনেটে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার গল্প

সম্প্রতি চীনের উহান ছাংচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা ও মিডিয়া বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সিয়াও হং চীনা অপেরায় অভিনয় করে চীনের ইন্টারনেটে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। জনপ্রিয়তা পাবার পর এক সাক্ষাত্কারে তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে বের হবার সময় ঘনিয়ে আসছিল; কোনো কোনো সহপাঠী ইন্টারশিপও শুরু করে দিয়েছিল। হলে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছিল। এ সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ করার আগে, চীনা অপেরা গাওয়ার মাধ্যমে নিজের জন্য স্মৃতি ধরে রাখতে চাইলেন। হলের টেবিলে সামনে বসে তিনি অপেরা গাইতে ও তা ভিডিও করতে শুরু করেন।

ছোটবেলা থেকেই চীনা অপেরা শুনতে পছন্দ করতেন সিয়াও হং। ৩/৪ বছর বয়সেই তিনি নানার সাথে অপেরা শুনতে শুরু করেন এবং নানার মতো অপেরা গাইতে চেষ্টা করেন। উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তির সময় তিনি পিতামাতার সাথে চীনা অপেরাকে মেজর হিসেবে নেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ করেন। তবে, তাঁর পিতামাতা মনে করেন যে, অপেরাকে মেজর হিসেবে নিলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অসুবিধা হবে। ফলে তিনি অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর মতো সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন; অপেরাকে আর তাঁর মেজর হিসেবে নেওয়া হয়নি।

ছাংচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস উহান শহরে অবস্থিত। উহানে চীনা অপেরার পরিবেশ বেশ ভালো ছিল। সিয়াও হং তাঁর সব ছুটির দিন অপেরা থিয়েটারে কাটাতেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপেরার থিয়েটারে যাওয়া-আসায় তিন ঘন্টারেরও বেশি সময় লাগে। মাঝে মাঝে থিয়েটারে সুবিখ্যাত অপেরা তারকা আসতেন। তখন অনেক দিন আগে টিকিট কেনার জন্য লাইনে অপেক্ষা করতে হতো তাকে।

থিয়েটারে অপেরা দেখা তাঁর জন্য বরাবরই ছিল আনন্দদায়ক ব্যাপার। প্রতিবার অপেরা দেখার পর তিনি প্রত্যেক তারকার অভিনয় ও গাওয়ার কৌশল নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি সংবাদদাতাকে থিয়েটারের মোট ৭৮টি কাগজের টিকিট দেখান। ই-টিকিট তো রয়েছেই। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত অপেরা থিয়েটারে মোট ৮২ বার গিয়েছেন সিয়াও হং।

সহপাঠীরা সবাই জানে যে, সিয়াও হং চীনা অপেরা বেশ পছন্দ করে। তবে তাঁর গাওয়া অপেরা কখনও তারা শুনে নাই। তাই, অনলাইনে চীনা অপেরা গেয়ে তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠার ব্যাপারটি ছিল সহপাঠীদের জন্য আশ্চর্যের। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “যদিও আমার অভিনয় ও গাওয়া তেমন একটা ভালো নয়, তবে নেটিজেনদের কাছ থেকে অনেক উত্সাহ পেয়েছি। আশা করি, আমার এ উদ্যোগের মাধ্যমে আরো বেশি চীনা যুবক অপেরা পছন্দ করবে।”

নভেম্বর মাসে সিয়াও হং জন্মস্থানে ফিরে যান। ভবিষ্যতে তিনি জন্মস্থান তালিয়ান শহরে একটি অপেরাবিষয়ক স্টুডিও চালু করতে চান। এই স্টুডিওতে এসে সাধারণ মানুষ অপেরার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতো মেকআপ নিতে পারবেন, তাদের মতো অপেরা গাওয়া চেষ্টা করতে পারবেন। এর মাধ্যমে চীনা অপেরা আরও জনপ্রিয় হবে।

 

অটিজমে আক্রান্ত শিশু-কিশোরদের ফুটবল দল

আধুনিক সমাজের উন্নয়ন ও চিকিত্সার মানের উন্নতির ফলে অনেক রোগ চিহ্নিত করা আজকাল অতীতকালের চেয়ে সহজতর হয়েছে। অটিজম তেমনি একটি রোগ। যারা ছোটবেলা থেকে অটিজম রোগে আক্রান্ত, তাদেরকে ‘তারার শিশু’ ডাকা হয়। চীনের হাইনান প্রদেশের হাইখৌ শহরে একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু আছে, যার প্রশিক্ষণার্থী বাচ্চাদের সবাই অটিজম রোগে আক্রান্ত। তাদের স্বাভাবিক জীবনকে মোটামুটি স্বাভাবিক করতে শিক্ষক শি হান প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সূর্যাস্তের আগে তিনি বাচ্চাদের নিয়ে খেলার মাঠে পৌঁছান এবং তাঁর নেতৃত্বে বাচ্চাদের শরীরচর্চা ক্লাস শুরু হয়। বর্তমানে তাঁর ক্লাসে মোট ৭টি শিশু আছে। তাদের ফুটবল খেলা শেখান তিনি। তিনি প্রত্যেক বাচ্চার সাথে কথা বলেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেন। এখন ফুটবলের অনেক কলাকৌশল শিখেছে বাচ্চারা।

৫০ মিনিটের ক্লাসে বাচ্চাদের নিয়ে ফুটবলের বিভিন্ন কৌশল চর্চা করেন তিনি। বাচ্চারাও এ খেলার মাধ্যমে শরীরচর্চার পাশাপাশি আনন্দ পায়। গবেষণা থেকে জানা গেছে, শরীরচর্চা অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের বিনিময়ের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এ কারণেই শিক্ষক শি বাচ্চাদের জন্য ফুটবলের ক্লাস চালু করেন।

২০১৯ সালে তিনি চীনের প্রতিবন্ধী তহবিলের অধীনে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ফুটবল কোচ হিসেবে কাজ করেন। টানা ৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা ও অনুসন্ধানের পর তিনি খেয়াল করেন যে, অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চারা অন্য বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এ দেখে তিনি অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের জন্যও ফুটবল প্রশিক্ষণ ক্লাস চালুর সিদ্ধান্ত নেন।

শুরুর দিকে তিনি দেখেন যে, অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চারা কখনও অন্য অপরিচিত লোকের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে না, কখনও তাদের সাথে কথাও বলে না। তবে, তাঁর অবিরাম প্রচেষ্টার পর কিছু কিছু বাচ্চা তাঁর কথা ও নির্দেশনা শুনতে শুরু করে এবং তার কথা অনুসারে প্রশিক্ষণেও অংশ নেয়। কোনো কোনো শিশু তাঁর সাথে দৃষ্টি বিনিময়ও করে। এটা তাঁর জন্য ছিল বড় অগ্রগতি। তিনি এতে অনেক খুশি হন। কারণ, বাচ্চারা তাঁকে পছন্দ করে, বিশ্বাস করে।

অটিজম যদি শুরুতে শনাক্ত করা যায় এবং যথাযথ ও উপযোগী চিকিত্সার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে আক্রান্তদের অবস্থা অনেক উন্নত হওয়া সম্ভব। শিক্ষক শি’র প্রচেষ্টায় দু’টি অটিজমে আক্রান্ত শিশু সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক স্কুলে পড়াশোনা শুরু করে।

অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের জন্য তিনি বিশেষ ফুটবল দল গঠন করেন এবং চীনের প্রতিবন্ধী তহবিলসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে অটিজম রোগের চিকিত্সার নতুন নতুন পদ্ধতিও অনুসন্ধান করছেন।

এখন তিনি অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের জন্য ফুটবলের পাশাপাশি অন্যান্য ক্রীড়ার ব্যবস্থাও করছেন। তা ছাড়া, স্কুলে একটি আবাসিক কমিউনিটি গঠিত হয়েছে, যেখানে সেলুন, সুপারমার্কেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা আছে। এখানে বাচ্চারা স্বাভাবিক জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। ছুটির দিনে তিনি অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের বিনামূল্যে চুল কেটে দেন। তিনি আশা করেন, সমাজের বিভিন্ন মহলের যৌথ প্রয়াস আরও বেশি অটিজমে আক্রান্ত শিশুর জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।

 

(সুবর্ণা/আলিম)