উত্তর ব্রাজিলের টোক্যান্টিনসে মারিয়া দিনিয়া নামক ছোট্ট একটি গ্রাম আছে। এটি দাসত্ব প্রথার সময়-পর্বে পালিয়ে যাওয়া দাসদের (কিলোম্বুর মানুষ) গ্রাম। অনুরূপ গ্রাম সাধারণত দুর্গম জঙ্গল বা প্রান্তরে অবস্থিত হয় এবং সেখানকার মানুষেরা খুবই দরিদ্র হন।
কিন্তু গত বছর থেকে একটি ফল প্রক্রিয়াকরণ কারখানা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের নারীদের জীবন বিরাট পরিবর্তন হয়েছে।
গ্রামের অধিবাসী মালেনা তার বাসায় নতুন কেনা সোফায় বসে নিজের জীবনের পরিবর্তন তুলে ধরেন। তিনি চাকরির আগে ও পরের জীবনের পরিবর্তন বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আগে আমি ছিলাম একজন গৃহিণী। কিন্তু গত বছর থেকে আমার চাকরি আছে। এখন আমি নিজের ব্যয়ে সোফা ও রেফ্রিজারেটর কিনেছি এবং কিস্তি পরিশোধ ছাড়া মোবাইল কিনতে পেরেছি। আমার ঘরের বাইরের দেয়াল সিমেন্ট দিয়ে তৈরি হচ্ছে। বলা যায়, স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। এছাড়া, বাসায় ইন্টারনেট বসানো হয়েছে। আমি অনলাইনে ব্যবসায়িক যোগাযোগ, ক্রয় ও বিক্রয় শিখে ফেলেছি।
মালেনা
মালেনা যেখানে কাজ করেন, সেই প্রক্রিয়াকরণ কারখানা চীনের স্টেট গ্রিড কর্পোরেশন ব্রাজিল হোল্ডিং কোম্পানির দ্বারা নির্মিত। এটি কোম্পানির মৌলিক পরিবেশ সংরক্ষণ পরিকল্পনার একটি প্রকল্প। বর্তমানে কারখানায় ১০ জন কর্মী আছে। তাদের মধ্যে ৯জনই নারী।
জানা গেছে, ব্রাজিলের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্বের বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্প চলাকালে বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিশন লাইন গ্রামের মধ্য দিয়ে চলার কারণে তার নির্মাতারা গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে এখানে বহু সংখ্যক ফল গাছ আছে এবং গ্রামবাসীরা ফল প্রক্রিয়াকরণ কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু স্থানীয় পানির গুনগত মান ভাল না। সুতরাং, কোম্পানি গ্রামের জন্য দু’টো কূপ খনন করার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে সুপেয় পানির উৎস সরবরাহ করার পাশাপাশি ফল প্রক্রিয়াকরণ কারখানা নির্মাণ করা যায়।
কোম্পানির পরিবেশ, সমাজ ও প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের সমন্বয়কারী জানান, প্রচেষ্টার মাধ্যমে কারখানা নির্মাণের পরিবেশ সুরক্ষা পারমিট পেয়ে কোম্পানির পরিবেশ সুরক্ষা পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করে। কোম্পানি আশা করছে, প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামটির টেকসই উন্নয়ন হবে।
২০১৮ সালের নভেম্বর কোম্পানির সাহায্যে গ্রামটিতে কারখানার কর্মশালার নির্মাণ সম্পন্ন হয়। ২০১৯ সাল থেকে গ্রামবাসীদের ফল তোলা ও যন্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। ২০২১ সালের প্রথম দিকে ব্যবসার অনুমতি পেয়ে অগাস্ট মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। কারখানায় উৎপাদিত মণ্ড আসে স্থানীয় কনিফার চেরি, আম, আনারস, প্যাশন ফল ইত্যাদি থেকে।
খাদ্য প্রকৌশলী গ্রেসিয়েলা পালুডো
খাদ্য প্রকৌশলী গ্রেসিয়েলা পালুডো স্থানীয় গ্রামবাসীদের মণ্ড বানাতে শিখান। তাদের তাজা ফল সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, মানসম্মত প্যাকিং ও শেলফ জীবন নিয়ন্ত্রণসহ প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও সাহায্য করেন।
তিনি বলেন, যদিও এখানে আসার পথ ভাল না এবং অনেক সময় লাগে। পরিশ্রম করে তারা পরিবারকে সমর্থন করতে পারেন এবং পরিবারের স্তম্ভে পরিণত হয়েছেন। এজন্য তারা খুব গৌরব বোধ করেন।
ফল প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় “কিলোম্বু বাগান” ব্র্যান্ডের মণ্ড উৎপাদিত হয়। দেশটির রাষ্ট্রীয় সরবরাহ কোম্পানি কারখানাটির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে সরকারি প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এই ব্র্যান্ডের মণ্ড খেতে পারে। এছাড়া, কারখানা কোন কোন হোটেল ও ব্যক্তিগত সংস্থার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে তাদের জন্য মণ্ড সরবরাহ করে। ফল প্রক্রিয়াকরণ কারখানার কর্মীদের গড় বার্ষিক আয় এখন ৮ হাজার ব্রাজিলিয়ান রিয়াল (বিআরএল) অর্থাৎ ১৫০২ মার্কিন ডলার।
গ্রামের বহু গাছের তৃণভূমি দিন ও রাতের তাপমাত্রা বেশি হবার কারণে গ্লাইকোপেক্সিসের জন্য অনুকূল হয়, তাই মণ্ডের স্বাদও ভাল হয়। পণ্যটির বিক্রয় দ্রুত বাড়ছে। অর্ডারের পরিমাণ খুব বেশি হলে আশপাশের বাজার থেকে ফল কিনে তা পূরণ করতে হয়। সুতরাং, মালেনা নিজের মাটিতে আরও কিছু ফল গাছ চাষ করতে চান।
তিনি বলেন, চীনা প্রতিষ্ঠানকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমরা আশা করি, কারখানা আরও সম্প্রসারিত হবে এবং পণ্যের বিক্রয় আরও দূরে যাবে। আমি বিশ্বাস করি, আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকলে চেষ্টার মাধ্যমে নিশ্চয়ই তা বাস্তবায়িত হবে।
(প্রেমা/এনাম)