গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত চীনের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিসি’র ২০তম জাতীয় কংগ্রেস বিষয়ে একটি সেমিনার ৫ নভেম্বর রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ চায়না সিল্ক রোড ফোরাম আয়োজিত সেমিনারে যোগ দেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। সেমিনারে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন তিনি। এতে সাংবাদিকদের প্রশ্নেরও জবাব দেন চীনা রাষ্ট্রদূত। বক্তব্য ও প্রশ্নোত্তর পর্বে সিপিসি’র ২০তম কংগ্রেস, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন ও স্থিতিশীলতা, তিস্তা ব্যারাজ, রোহিঙ্গা ইস্যুসহ দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন লি জিমিং। বাংলাদেশের গণমাধ্যম গুরুত্বের সঙ্গে চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য প্রচার ও প্রকাশ করেছে।
আজকের সংবাদ পর্যালোচনায় আমরা নজর দেব বিষয়টির দিকে।
সেমিনারে মূল বক্তব্যে লি জিমিং জানান, সদ্য সমাপ্ত সিপিসি’র ২০তম জাতীয় কংগ্রেসে পার্টির বিগত সময়ের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। চীনের দারিদ্র্য দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সিপিসির বড় অর্জন। আধুনিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের দিকে আরও এগিয়ে যাওয়া হলো পার্টি ও চীনের জনগণের লক্ষ্য।
আলোচনায় বাংলাদেশ-চায়না সিল্ক রোড ফোরামের চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী দীলিপ বড়ুয়া এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননও চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। দিলীপ বড়ুয়া বলেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন এ সময়ে চীনের মূল শক্তি। আর রাশেদ খান মেনন বলেন, নতুন সময়ে সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সহায়ক হবে সিপিসি’র ২০তম কংগ্রেস।
বর্তমান বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক সংকট চলছে, সে সময় চীন উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে এবং বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। কীভাবে চীন তার উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে বিশ্বের বিস্ময় সৃষ্টি করেছে এবং এর পিছনে কী ম্যাজিক রয়েছে- চীন আন্তর্জাতিক বেতারের এমন প্রশ্নের জবাবে লি জিমিং বলেন, ‘উন্নয়নের জন্য চায়নিজ ম্যাজিক হলো জনগণের কল্যাণ চিন্তা এবং মার্ক্সীয় আদর্শে দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখা।’
রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের এ বক্তব্যে এটি স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, জনগণের কল্যাণই সিপিসি ও চীনের নেতাদের অভীষ্ট এবং জনগণই সবকিছুর কেন্দ্রে। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারণাই শেষ কথা নয়, চীনে জনগণের গণতন্ত্র রয়েছে।
সিপিসি’র ২০তম কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ এবং বিশ্বশান্তির পক্ষে চীনের অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন লি জিমিং।
বন্ধুরাষ্ট্র চীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন অংশীদার। পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, বিভিন্ন মৈত্রীসেতুসহ অসংখ্য বড় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সহযোগী চীন।
এরই ধারাবাহিকতায় চীন তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী বলে জানান লি জিমিং। চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ সরকার চাইলে তিস্তা ব্যারাজ বাস্তবায়নে অর্থ কিংবা প্রযুক্তি কোনো বাধা নয়।
তিস্তা ব্যারাজ নিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝিরও ব্যাখ্যা দেন চীনা রাষ্ট্রদূত। তিস্তা ব্যারাজ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বাইরের চাপে আছে- এ প্রসঙ্গে লি জিমিং বলেন- এমন কথা তিনিও শুনেছেন, তবে তিনি জানেন না এ চাপটি কোথা থেকে আসছে। তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের প্রাকসম্ভাব্যতা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে লি জিমিং বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু ভাটিতে রয়েছে তাই এখানে ব্যারাজ হলে উজানের কোনো দেশের ক্ষতি হবে না। তাছাড়া সীমান্তের কাছাকাছি কোনো বাঁধ নির্মাণেরও পরিকল্পনা নেই এ প্রকল্পে।
তিস্তার উৎসে বাঁধ দিয়ে চীন পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে এমন মিডিয়া রিপোর্টকে বানোয়াট উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, তিস্তার উৎস ভারতের সিকিমে, চীনে নয়।
তিস্তা ব্যারাজ নিয়ে রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের বক্তব্যে চীনের অবস্থান একেবারেই স্পষ্ট। এখন এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় সংকল্প ও সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবদিক বিবেচনা করা বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
কোনো দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ চীনের পররাষ্ট্র নীতি নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও চীন এটি বজায় রেখেছে বেইজিং। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ও স্থিতিশীলতা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত আবারো স্পষ্ট করে বলেন, চীন কখনও আধিপত্যবাদে বিশ্বাস করে না এবং অন্য দেশের নিজস্ব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।
তবে রাষ্ট্রদূত জোর দিয়ে বলেন, যেহেতু উন্নয়নের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা দরকার। তাই তিনি আশা করেন বাংলাদেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।
সেমিনারে চীনা রাষ্ট্রদূত স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়েও কথা বলেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনেকগুলো পক্ষ জড়িয়ে গেছে। কোনো কোনো পক্ষ তাদের প্রত্যাবাসনেরই পক্ষে। চীন বরাবর রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে এ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে, রোহিঙ্গাদে ফেরার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন লি জিমিং। রোহিঙ্গা সমস্যা দ্রুত সমাধান না হলে তা আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলতে পারে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন চীনা রাষ্ট্রদূত।
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে- বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণের চাওয়া চীনের অনুরূপ। বাংলাদেশও রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন চায়। এ ক্ষেত্রে চীন ভবিষ্যতেও জোরালো ভূমিকা নেবে বলে প্রত্যাশা বাংলাদেশের মানুষের।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।