আফরিন মিম, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: চাল-আটাসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো বাংলাদেশে অস্থির হয়ে উঠেছে চিনির বাজার। মুদিপণ্য এমনকি পাইকারি বাজারের বেশিরভাগ দোকানেও এই পণ্যটি পাওয়া যাচ্ছে না।
শুধু সংকটই নয়, বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে ইচ্ছামতো দামে। কোনো দোকানে খোলা চিনি ১০৫ টাকা, কোনো দোকানে ১১০ টাকা, আবার কোনো দোকানে ১২০ টাকা দরেও বিক্রি করা হচ্ছে। যদিও খোলাবাজারে সরকার নির্ধারিত দর ৯০ টাকা কেজি। প্যাকেটজাত চিনির ক্ষেত্রে দরটি ৯৫ টাকা। যদিও দোকানে এই চিনি পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজধানীর কাঁটাবন, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, কলাবাগান, মগবাজার এলাকা ঘুরে গতকাল বুধবার এ চিত্র দেখা যায়।
এদিকে অক্টোবর মাসের শুরুতে খুচরা বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হয় ৮৪ টাকা করে। স্থানীয় পরিশোধনকারী মিলগুলোর উৎপাদন খরচ বিবেচনায় নিয়ে সরকার গত ৬ অক্টোবর কেজিতে দাম ছয় টাকা বাড়িয়ে দেয়। এতে খোলা চিনির দাম হয় ৯০ টাকা। যা বর্তমানে বাড়িয়ে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে।
দেশে চিনির চাহিদা ও সরবরাহ
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন। এই চিনির প্রায় পুরোটা বিদেশ থেকে আমদানি করে পরিশোধন করা হয়।
দৈনিক ৬ হাজার টনের চাহিদা থাকলেও সারাদেশে সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২ থেকে আড়াই হাজার টন চিনি। এতে করে নিত্যপণ্যের বাজারে চিনির সংকট আরও বাড়ছে। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত চিনি ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আগে থেকেই চিনির দাম বাড়ছিল। তবে দুই সপ্তাহ আগে থেকে সরবরাহে ঘাটতি শুরু হয়।
এদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গত ২৩ থেকে ২৯ অক্টোবর অর্থাৎ ৭ দিনে সারা দেশে চিনি সরবরাহের যে হিসাব বড় বড় চারটি কোম্পানি সরকারকে দিয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে দৈনিক ৫ হাজার টন চাহিদার বিপরীতে মিল থেকে ৫ হাজার ২১৮ টন সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিনি সরবরাহ করেছে মেঘনা গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি ১৬ হাজার ৩৮৪ মেট্রিক টন চিনি সরবরাহ করেছে। এর পরেই রয়েছে সিটি গ্রুপ। তারা ১১ হাজার ১৯৮ মেট্রিক টন চিনি বাজারে ছেড়েছে। এছাড়া এস আলম গ্রুপ ও দেশবন্ধু গ্রুপের বাজারে চিনি সরবরাহের পরিমাণ যথাক্রমে ৫ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন ও ৩ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন।
যা বলছে টিসিবি এবং চিনি পরিশোধনকারী কোম্পানী
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়। এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। সব মিলিয়ে এক মাসে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ।
চিনি পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, সরবরাহে এই ঘাটতি তৈরি হয়েছে গ্যাসের অভাব ও লোডশেডিংয়ের কারণে। কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম ঠিকভাবে চালানো যাচ্ছে না।
কি বলছে খুচরা ব্যবসায়ীরা
এ বিষয়ে রাজধানীর খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেন, তিন থেকে চার দিন আগে চিনি কেজিপ্রতি ৯৫ টাকা দামে বিক্রি করেছি। সেটা এখন ১১০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। বস্তা প্রতি চিনির দাম এক হাজার ৫০ টাকা বেড়েছে।
ইস্কাটন এলাকার খুচরা চিনি বিক্রেতা মো. নিয়ামুল আলম জানান, তিনদিন আগেও ৫০ কেজির চিনির বস্তা কিনেছি ৪২৫০ টাকায়, সেটা আজ ৫৩০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ বস্তাপ্রতি ১০৫০ টাকা বেড়েছে।
হাতিরপুল এলাকার খুচরা বিক্রেতার সমুন জানায় , ১০৬ টাকা করে কিনে ১১০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এ অস্বাভাবিক বাজারে পণ্য কিনতেও ভয় লাগে। বাজার দাম কমে গেলে লসে বিক্রি করতে হবে। তবে এর আগে কখনো চিনির দাম ১০০ টাকার বেশি ওঠেনি।
কি বলছে ক্রেতারা
দাম বাড়িয়ে নির্দিষ্ট করার পরও কেজিপ্রতি চিনির মূল্য ২০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এমনটি হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে বাংলামোটর এলাকার বাসিন্দা আরিফা বলেন, এক সপ্তাহ না যেতেই চিনির দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে যাওয়াটা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছিনা। সরকার দু’সপ্তাহ আগেই ৬ টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার পর মনে করেছিলাম চিনির দাম আর বাড়বে না। অথচ আজ কেজিতে ২০ টাকা বেড়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান
তবে চিনির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। নেতৃত্ব দিচ্ছে ভোক্তা অধিদপ্তরের একাধিক টিম।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিপ্তরের ডিজি / মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, চিনি মিল থেকে ডিস্ট্রিবিউট হওয়ার পর থেকে একদম রিটেইল পর্যায়ে আসার মাঝখানে হয়তোবা কোন কারসাজি থাকতে পারে। এবং সেটার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কোথাও যদি মজুদ করা হয় সেখানে আমরা অভিযান করছি।
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান , মহাপরিচালক, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর
কি বলছে সরকার
আগামি দু-একদিনের মধ্যে দেশে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে চাহিদা অনুযায়ী চিনি উৎপাদন সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গ্যাস সরবরাহে অপ্রতুলতার কারণে চিনি উৎপাদন ঠিকভাবে হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
“ যে সমস্যা আমরা পেয়েছি সেটি হলো গ্যাসের সাপ্লাই অপ্রতুলতার কারণে ৬৬ শতাংশের বেশি চিনি উৎপাদন করতে পারছে না। আশা করি দু-একদিনের মধ্যে গ্যাসের সাপ্লাই স্বাভাবিক হলে যে পরিমাণ চিনি দরকার তা উৎপাদন সম্ভব হবে” ।
সম্পাদনা- সাজিদ রাজু