চীনের পরিবেশ রক্ষা-বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র ‘দারিদ্রমুক্ত দেশ-দুই: একটি গুপ্তধন’
2022-10-27 10:47:02

 

২০২১ সালে শ্রেষ্ঠ ডোমেস্টিক তথ্যচিত্রের কথা বলতে গেলে  ‘দারিদ্রমুক্ত দেশ’ নিঃসন্দেহে শীর্ষ ৩টিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এ প্রামাণ্যচিত্রের উপস্থাপক হংকংয়ের অভিনেত্রী ছেন ব্য আর ওরফে জ্যানিস চান। এই প্রামাণ্যচিত্র তৈরির কারণে ‘‘চীনকে মুগ্ধ করা ২০২১ সালের বার্ষিক ব্যক্তিত্ব’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

 

যখন  ‘দারিদ্রমুক্ত দেশ’ প্রচারিত হচ্ছিলো, তখন অনেকে জিজ্ঞাস করেন, এ প্রামাণ্যচিত্রের সিরিজ পর্ব বের হবে কিনা? চলতি বছরের গ্রীষ্মকালে ‘দারিদ্রমুক্ত দেশ-দুই: একটি গুপ্তধন’ দর্শকদের সামনে হাজির হয় এবং প্রথম সিরিজের মতো অসংখ্য দর্শকদের প্রশংসা ও সমাদর পেয়েছে।

 

এই মৌসুমের থিম চীনের পরিবেশগত পুনর্গঠনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। সম্পূর্ণ চিত্রগ্রহণের প্রক্রিয়া দারুণ কঠিন ছিল। পাঁচজনের ক্রু ৩ মাসের মধ্যে ১০টিরও বেশি প্রদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

 

এ তথ্যচিত্রের মাধ্যমে আমরা দেশের সবুজ রূপান্তরের সংকল্প দেখতে পেয়েছি এবং জানতে পারি যে, বিভিন্ন অঞ্চলে এমন অনেক মানুষ আছেন- যারা নীরবে দূষণমুক্ত জল ও সবুজ পাহাড়কে রক্ষা করছেন।

 

‘দারিদ্রমুক্ত দেশ-দুই: একটি গুপ্তধন’ নামে তথ্যচিত্রের চিত্রগ্রহণের সময় ছেন ব্য আর শত শত তিব্বতি হরিণকে খ্যখ্যসিলি অঞ্চলের মাটিতে দৌড়াতে দেখেছিলেন। চোখে জল নিয়ে তিনি চিৎকার করে বলেছেন, ‘এই দৃশ্যটা খুবই হৃদয়স্পর্শী’।

 

ইয়াংজি নদীর উৎসে অবস্থিত ‘খ্যখ্যসিলি’ এর চীনা ভাষায় অর্থ ‘সুন্দরী মেয়ে’। এখানে উচ্চ উচ্চতা এবং কঠোর প্রাকৃতিক পরিবেশ রয়েছে। এটি চীনের চারটি জনবসতিহীন অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি এবং তিব্বতীয় হরিণগুলোর সর্বাধিক ঘনীভূত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি।

 

বিংশ শতাব্দীর ৮০’র দশকে উন্মত্ত চোরা শিকারি খ্যখ্যসিলিতে একটি বিপর্যয়কর আঘাত এনেছিল। চোরা শিকারিরা মাত্র দশ সেকেন্ডের মধ্যে একটি তিব্বতি হরিণের চামড়া ছাড়াতে পারতো। ফলে তিব্বতি অ্যান্টিলোপের সংখ্যা তখন দু’লাখেরও বেশি থেকে ২০ হাজারে কমে দাঁড়ায়।

 

তিব্বতি অ্যান্টিলোপ মালভূমির বাস্তুসংস্থানের সম্পূর্ণ খাদ্য শৃঙ্খলকে সমর্থন করে। যদি তিব্বতি অ্যান্টিলোপ অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে ভাল্লুক, নেকড়ে, ঈগল এমনকি কাকও তাদের খাদ্য উৎস হারাবে এবং মালভূমির পরিবেশগত ভারসাম্য ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

তথ্যচিত্রে ছেন ব্য আর খ্যখ্যসিলি’র রক্ষী ছিউপেইচাসি এবং বন পুলিশ পুছুওছাইরেনের সাক্ষাতকার নিয়েছেন। তারা যমজ ভাই। তাদের চাচা সুওনানতাচিয়ে এবং বাবা চাবাতুওচিয়ে তিব্বতীয় হরিণ সুরক্ষায় পরিশ্রম করেছেন, তথা যার যার প্রাণও উৎসর্গ করেছেন।

 

১৯৯২ সালে সুওনাতাচিয়ে ছিংহাই প্রদেশের চিতুও জেলার পার্টি কমিটির ডেপুটি সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে চীনের প্রথম অস্ত্রধারী অ্যান্টি-পোচিং স্কোয়াড নির্মিত হয়। দু’বছর পর একবার পাহাড় পাহারা অভিযানে সুওনাতাচিয়ে ১৮ জন শিকারির সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধ শুরু করে। বেশ কয়েকবার গুলি খেয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বন্দুকটি ধরে রাখার ভঙ্গি বজায় রাখেন তিনি।

 

বাবার আত্মত্যাগের কথা বলতে গিয়ে ক্যামেরার সামনে চোখের জল চেপে ধরেন পুছুওছাইরেন। সুওনানতাচি’র কাহিনী প্রজাপতির প্রভাব সৃষ্টি করেছিল এবং আরও বেশি লোককে পাহারা দেওয়ার পদে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেছিল।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশ ক্রমাগত পরিবেশগত সুরক্ষা জোরদার করে আসছে এবং খ্যখ্যসিলিতে তিব্বতি হরিণের শিকার অদৃশ্য হয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ স্থানীয় তিব্বতি হরিণের সংখ্যা তিন লাখেরও বেশি বেড়েছে,

 

ফলে তার অবস্থান ‘বিপন্ন প্রজাতি’ থেকে ‘প্রায় বিপন্ন প্রজাতি’-তে নেমে এসেছে। শিকারি বন্দুকের শব্দ আর খ্যখ্যসিলি রিজার্ভে শোনা যায় না, তবে আরেকটি নতুন সমস্যা মালভূমির বাস্তুসংস্থানকে হুমকির মুখে ফেলেছে। তাও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

 

২০২১ সালের গ্রীষ্মকালে প্রচারিত দু’শ মিটারেরও বেশি লম্বা এবং প্রায় ২০ মিটার চওড়া একটি বিশাল আবর্জনা প্যাচের প্রতিবেদন সবার নজর কেড়েছে। আ চিং, যিনি কুয়াংচৌ শহরে আছেন, প্রতিবেদনটি দেখে হতবাক হয়েছিলেন। কারণ ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে ইয়াংজি নদীর উৎস পবিত্র এবং সুন্দর হওয়া উচিত, কেন এত আবর্জনা? তাই আ চিং চাকরি ছেড়ে ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার প্রভাবে আশেপাশের লোকেরা নিজেদের উদ্যোগে পরিবেশ সুরক্ষা করা শুরু করেন।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইয়াংজি নদীর জৈবিক অখণ্ডতা সূচক ‘কোন মাছ নেই’ এই সবচেয়ে খারাপ স্তরে পৌঁছেছে। প্রচলিত ধারণায় জেলেরা প্রথাগত পদ্ধতিতে মাছ ধরতে পারছেন না। ২০২১ সাল থেকে ইয়াংজি নদীতে ১০ বছরের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়।

 

‘দারিদ্রমুক্ত দেশ-দুই: একটি গুপ্তধন’ নামের তথ্যচিত্রের তৃতীয় পর্বে ছেন ব্য আর মাছ সুরক্ষা সংক্রান্ত বেসরকারি দলের স্পিড-বোটে পা রাখেন এবং গভীর রাতে ইয়াংজি নদীর টহল অনুভব করেন। এই বেসরকারি দলের অধিনায়ক হলেন লিউ হোং, যিনি ছোংছিংয়ের চিয়াংচিনে থাকেন এবং ছোটবেলায় তার ভাইয়ের সঙ্গে মাছ ধরতেন।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বন্য মাছের প্রতি জনগণের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় অবৈধ বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে মাছ ধরা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ইয়াংজি নদীর মাছগুলো অদৃশ্য হতে চলছে দেখে নির্মাণ ব্যবসায় কিছু টাকা সঞ্চয় করা লিউ হোং ২০১৪ সালে ইয়াংজি নদীতে মাছ সুরক্ষার স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনের নেতৃত্ব দেন।

 

বিগত ৮ বছরে লিউ হোং ইয়াংজি নদীতে হাজার হাজার রাত কাটিয়েছেন এবং তার সাহায্যে মৎস্য বিভাগ দু’হাজারেরও বেশি অবৈধ মাছ ধরা বন্ধ করেছে।

 

তথ্যচিত্রে সাক্ষাতকার নেওয়ার প্রথম রাতে মাছ সুরক্ষা দল টহল দেওয়ার ৪ ঘণ্টার মধ্যে শিকারিদের আবিষ্কার করেছে এবং ৪টি অবৈধ মাছ ধরার বড়শি জব্দ করেছে। একটি মাছ ধরার বড়শির সাথে ১৬টি হুক সংযুক্ত দেখে ছেন বে আর হতবাক হয়ে গেলেন।

 

মৎস্য বিভাগের গ্রেফতার এড়াতে একসময় অবৈধ চোরাচালান নৌকার বদলে উচ্চ হর্স-পাওয়ারের স্পিড-বোট বসানো হয়। লিউ হোং অনুভব করেছিলেন যে, মাছ সুরক্ষার জন্য নৌকাটিকেও উন্নত করতে হবে। তিনি নিজের খরচে আরও বড় হর্স-পাওয়ার এবং আরও লাইটার হুলসহ একটি ক্র্যাশ-প্রুফ স্পিড-বোট তৈরি করেছেন। সরঞ্জাম ক্রয় এবং ক্রুজিং জ্বালানী খরচ যোগ করে, লিউ হোং কয়েক বছর ধরে মাছ সুরক্ষার জন্য মিলিয়ন ইউয়ান ব্যয় করেছেন।

 

মাছ সুরক্ষার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, লিউ হোং বলেন: ‘আমি আমার নিজের খাদ্য এবং পোশাক জোগাড় করেছি এবং আমাদের সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের জন্য এ কাজ করছি।’

 

উদ্দেশ্য যতই ভালো হোক না কেন, বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। অবৈধ মাছ ধরার বিপুল মুনাফায় মাছ রক্ষার স্বেচ্ছাসেবকদের বিশাল হুমকি সৃষ্টি হয়। তারা মাছ রক্ষা করতে স্বেচ্ছায় কাজ করছে, এক বা দুইজনের বিরুদ্ধে নয়, বরং বন্য মাছ ধরার স্বার্থের পুরো চেইনের মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

 

মাঝে মাঝে লিউ হোং অবৈধ চোরা-শিকারিদের ‘চোখের কাঁটা’ হিসাবে বিবেচিত হয়েছিলো। তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, গুজব ছড়ানো হয়েছে এবং তাকে মারধর করা হয়েছে।

 

কিছু লোক স্বেচ্ছাসেবক টহলের বৈধতা নিয়ে সন্দেহও  প্রকাশ করেছেন। লিউ হোং বলেছেন: ‘অবৈধ এবং অপরাধমূলক কাজের মুখে যেকোনো নাগরিকের তাদের থামানোর অধিকার আছে।’

 

কিছু স্বেচ্ছাসেবক যারা মাছ রক্ষায় তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল- তারা ভয়ে নিজেদের প্রত্যাহার করেছিল। তবে, তাদের বেশিরভাগই এ কাজে  থেকে গেছে। দিনের বেলায় তারা সাধারণ মানুষ—যেমন, নিরাপত্তারক্ষী, জেলে এবং কৃষক। তবে, রাতে তারা মাছ সুরক্ষার সাহসী লোকে পরিণত হন।

 

যেহেতু ইয়াংজি নদীর বাস্তুসংস্থানের দিকে জনগণের মনোযোগ বেড়েছে, সেহেতু এই ব্যক্তিগত মাছ রক্ষার দলটি আরও বেশি সামাজিক সমর্থন পেয়েছে।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিয়াংচিন মৎস্য বিভাগ মাছ সুরক্ষার স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য দুর্ঘটনা বীমা ক্রয় করতে শুরু করেছে এবং মাছ সুরক্ষা নৌকাগুলোর তেল খরচের অংশও ফেরত দিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক কাজে আরও বেশি তরুণ-তরুণী অংশগ্রহণ করেছে।

 

যদি স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে অর্থ অবদান রাখতে ইচ্ছুক কোনো ধনী লোক না থাকে, তাহলে কি পরিবেশ রক্ষার কাজ চলতে পারে? উত্তর হলো ‘হ্যাঁ’।

 

‘দারিদ্রমুক্ত দেশ-দুই: একটি গুপ্তধন’ শিরোনামে তথ্যচিত্রের ক্রুরা সিনচিয়াংয়ের থিয়েনশান পাহাড়ে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের অনুসরণ করে তুষার চিতার ছায়া খুঁজে পাওয়ার আশা পোষণ করেন।

 

এসব স্বেচ্ছাসেবক ‘হুয়াং ইয়ে সিন চিয়াং’ বা ‘মরুভূমি সিনচিয়াং’ গ্রুপের সদস্য। আগামী বছর এই গ্রুপ প্রতিষ্ঠার দশম বার্ষিকী পালিত হবে। প্রথমে এ গ্রুপের স্বেচ্ছাসেবকরা থিয়েনশান পর্বতমালায় বন্য প্রাণীদের বিতরণের অবস্থা তদন্তের জন্য চাঁদা দিয়ে কেনা শতাধিক ইনফ্রারেড ক্যামেরা খাড়া পাহাড়ের উপর রেখে ছিলেন।

 

এসব ক্যামেরা আকস্মিকভাবে বন্য তুষার চিতাবাঘের থাবার প্রিন্ট ধারণ করেছে। তুষার চিতাবাঘকে ‘তুষার পর্বতের রাজা’ বলা হয়। এরা আলপাইন বাস্তুতন্ত্রের শীর্ষ শিকারি এবং একটি অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।

 

এসব স্বেচ্ছাসেবকের সংগৃহীত ছবি ও ভিডিওয়ের মাধ্যমে জনগণ তুষার চিতাবাঘের শিকার করা, ঘুমিয়ে পড়া ও ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন।

 

কেউ কেউ বলেন, প্রকৃতি রক্ষার আদর্শ অবস্থা হলো সুরক্ষা। আর তা সমস্ত জনগণের ব্যাপার হয়ে উঠেছে। কেবল অনেক লোক এই কাজ করলেই এই কাজে অংশ নিতে আরও বেশি লোককে উত্সাহিত করা সম্ভব হবে।

 

‘দারিদ্রমুক্ত দেশ-দুই: একটি গুপ্তধন’ শিরোনামের প্রামাণ্যচিত্র প্রচারের সময় ছেন বে আর বলেন, ‘এই পৃথিবী শুধু উঁচু ভবন, কোল্ড নম্বর এবং ইলেকট্রনিক পণ্য নয়; পাহাড়, জল এবং প্রাণী, প্রকৃতি এবং মানুষ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।’

লিলি/এনাম/রুবি