বৈশ্বিক দারিদ্র্যবিমোচনে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভূমিকা
2022-10-26 10:51:57

 

খাদ্য নিরাপত্তা যে কোনো দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। বর্তমানে চীনের মাথাপিছু উৎপাদিত খাদ্যের পরিমাণ ৪৮৩.৫ কেজি। তা বিশ্ব স্বীকৃত নিরাপত্তা সীমা তথা ৪০০ কেজির বেশি। চীন তার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি, চীনের কৃষি প্রযুক্তি দেশের বাইরে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কাজে লাগছে। চাইনিজ একাডেমি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্সের উদ্যোগে  ২০০৮ সালে চালু হয় এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র এলাকায় গ্রিন সুপার রাইস চাষ। এটি আসলে আন্তর্জাতিক কৃষি দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প। এ পর্যন্ত এশিয়া ও আফ্রিকার ১৮টি দেশে মোট ৬১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে এর চাষ হয়েছে।

 

কেনিয়ার একজন সাংবাদিক বলেছেন,  চীন ইতোমধ্যে অনেক দৃষ্টান্তমূলক সফলতা অর্জন করেছে। শুধু চীন এসব সফলতা থেকে উপকৃত হয়েছে- তা কিন্তু নয়। যেমন: কয়েক দশক ধরে বিশ্ব দারিদ্র্যবিমোচনে চীনের অবদান ৭০ শতাংশ। তার মানে চীনের সফলতা হল সারা বিশ্বের সফলতা।

 

দীর্ঘসময়ে দুর্ভিক্ষ হলো সাব-সাহারান আফ্রিকার জন্য বৃহত্তম সমস্যা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয় রুশ-ইউক্রেন সংঘর্ষ। ফলে আফ্রিকায় খাদ্য সংকট আরও গুরুতর হয়েছে। বিশাল এ মহাদেশে অধিকাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভর করে। যেমন: নাইজেরিয়ার জিডিপিতে কৃষির অনুপাত ৪০ শতাংশ। তবে, সেদেশের ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজ করে। এখনও নাইজেরিয়ায় খাদ্য সংকট রয়েছে। প্রতিবছর  চাল, গম, সুক্রোজ এবং মাছ আমদানিতে দেশটিকে বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।

 

২০০৮ সালে চীনের উদ্যোগে চালু হয়েছে গ্রিন সুপার রাইস চাষের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প। চীন সরকার ও বিল গেটস তহবিলের অর্থনৈতিক সহায়তায় চাইনিজ একাডেমি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্স ও দেশি-বিদেশী ৫৮টি ধান গবেষণালয় এতে অংশগ্রহণ করেছে।

 

গ্রিন সুপার রাইস বা সবুজ সুপার ধানের ধারণাটি চীনের অধ্যাপক চাং ছি ফা ২০০৫ সালে প্রথম বারের মতো উত্থাপন করেন। এ ধরনের ধানের গুণগত মান ভাল, উৎপাদনের পরিমাণ বেশি এবং রোগ ও কীটপতঙ্গ প্রতিরোধক, জল সাশ্রয়, খরা প্রতিরোধকসহ নানা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।

 

কেন এ ধরনের ধান প্রয়োজন? প্রায় ৫০ বছর আগ থেকে চীনের ধান বীজ লালনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সফলতা দেখা যায়। তা বিশ্বব্যাপী প্রথম গ্রিন বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে বামন প্রজননের মাধ্যমে চীনের ধান উৎপাদনের পরিমাণ ২০ শতাংশ বৃদ্ধি হয় এবং  ৭০-এর দশকে হাইব্রিড ধান আবিষ্কার হলে উত্পাদন পরিমাণ আরও ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণালয় সুপার রাইস ধারণা উত্থাপন করেছে। ফলে চালু হয় সুপার ধান বীজ প্রজনন পরিকল্পনা। তখন থেকে পরবর্তী ৩০ বছর সময়ে চীনা বিশেষজ্ঞদের প্রচেষ্টায় নতুন ধানের প্রজাতি আবিষ্কার  হয় এবং ধান উৎপাদনে দক্ষতা দিন দিন বেড়েছে।

 

অবশ্যই এতেও কিছু সমস্যা ছিল। বিশেষ করে সুপার রাইসের জন্য প্রচুর পানি ও সার দরকার হয়। তবে, চীনের ৭০ শতাংশ ধান ক্ষেতে এমন কোন পরিবেশ নেই। দ্বিতীয়ত, বেশি ধান চাষ হলে সার ব্যবহারে জমি ও নদীর ক্ষতি হয়। পাশাপাশি, পরিবেশও নষ্ট হয়। তাছাড়া, চীন একটি খরা প্রবণ ও পানি সম্পদের অভাবের দেশ। বিশ্বের ১৩টি মাথাপিছু পানি সম্পদ সবচেয়ে কম দেশের অন্যতম চীন। পাশাপাশি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে  উচ্চ ও নিম্ন তামপাত্রা, খরা ও বন্যা  মাঝে মাঝে দেখা দেয়। তা কৃষি উত্পদান আরও অনিরাপদ করে তুলে। তাই চীনে শুরু হয় সবুজ সুপার রাইস প্রকল্প। চীন বিদেশে নিজের এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কাজ করে।

 

২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চীন তিন বার পূর্ব আফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি চীনের কুই চৌ, ইউন নান, সি ছুয়ান, কুয়াং সি ও নিং সিয়া প্রদেশে সবুজ সুপার ধান পরীক্ষামূলক চাষ করে।

 

চীন বিশ্বের বৃহত্তম ধান উত্পাদন ও ভোগ্য দেশ এবং বিশ্বের প্রথম দেশ যে হাইব্রিড ধান আবিষ্কার ও প্রচার করেছে। গ্রিন সুপার রাইসের গবেষণা ক্ষেত্রেও চীন উন্নত অবস্থায় রয়েছে। তাই আফ্রিকার কৃষকদের জন্য চীনের অভিজ্ঞতা কার্যকর হয়েছে।

 

তবে, আফ্রিকার জমি, পরিবেশ ও চাষের পদ্ধতি চীনের তুলনায় অনেক ভিন্ন হয়। সরাসরি চীনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইলে হবে না।

পশ্চিম আফ্রিকায় নাইজেরিয়া ও মালি দুটি দেশ বাছাই করেছে চীন। কারণ মালিতে রয়েছে পরিপক্ব বীজ যাচাইকরণ ব্যবস্থা এবং পশ্চিম আফ্রিকার মাঝা-মাঝিতে অবস্থিত। নাইজেরিয়ার কৃষি গবেষণা তুলনামূলক উন্নত। শুরুতে স্থানীয় বীজ কোম্পানির সঙ্গে প্রদর্শন এবং প্রচার করে। তারপর এ বীজ স্থানীয় কৃষকদেরকে দেয়া হয়। তিন বছরের মধ্যে দেশ দুটিতে যদি ভাল ফলাফল অর্জিত হয়, তাহলে পশ্চিম আফ্রিকা এমনকি সারা আফ্রিকায় তা পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে।(শিশির/এনাম/রুবি)