এক পেশায় সারা জীবন ব্যস্ত থাকা এবং একজন শান চি সিয়াং
2022-10-24 17:01:57

রাজপ্রাসাদ তথা নিষিদ্ধনগর চীনের একটি সুবিখ্যাত জাদুঘর ও দর্শনীয় স্থান। গত কয়েক বছরর এক ভদ্রলোকের নেতৃত্বে রাজপ্রাসাদের অনেক নতুন সংস্কার হয়েছে, বিভিন্ন মজাদার প্রদর্শনী আয়োজিত হচ্ছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে, বিভিন্ন সুভেনির বের হয়েছে। তিনি রাজপ্রাসাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে কাজ করে গেছেন নিরলস।

ফলে অনেকে বিশেষ করে শিশু-কিশোররা রাজপ্রাসাদের ইতিহাস ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে জানার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছে উঠেছে। আজকের আসরে আমরা চীনের রাজপ্রাসাদের সাবেক মহাপরিচালক শান জি সিয়াংয়ের গল্প তুলে ধরবো।

সম্প্রতি এক সাক্ষাত্কারে শান চি সিয়াং নিজের কর্ম-অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বলেন, যে-কোনো কাজ পরিশ্রমের সাথে করা প্রয়োজন। চাকরি বদলের সম্ভাবনা সবসময়ই থাকবে। কিন্তু চাকরি বেছে নিয়ে প্রত্যেকের উচিত সারা জীবন এ কাজেই লেগে থাকা। এই লেগে থাকাটা খুব জরুরি।

শান চি সিয়াং বেইজিংয়ের হুথং এলাকার সিহ্যইউয়ান তথা বড় উঠোনে বড় হয়ে ওঠেন। তখন তিনি হুথং বা অলিগলির বেইজিংবাসীর আন্তরিকতা খুবই পছন্দ করতেন। স্কুলজীবন শেষ করার পর তিনি একাধিক চাকরির সুযোগ পান। প্রথমে বেইজিং নগর পরিকল্পনা ব্যবস্থাপনা ব্যুরোতে তুংছেং এলাকার উন্নয়ন পরিকল্পনাকারী হিসেব কাজ করেন তিনি। পরে বেইজিং মহানগরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ এলাকার তদন্তকাজে যোগ দেন। ১৯৯৪ সালে তিনি বেইজিং সাংস্কৃতিক অবশেষ ব্যুরোর প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। তখন থেকে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের সাথে জড়িত কাজ করা শুরু করেন।

জনাব শান চি সিয়াংয়ের পূর্বপুরুষরা চিয়াংসু প্রদেশের চিয়াংনিং শহরের। তবে তিনি চীনের লিয়াওনিং প্রদেশের শেনইয়াং শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩ মাস বয়সে পিতামাতার সাথে বেইজিংয়ে চলে আসেন। ছোটবেলা থেকে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয় তাঁর। কারণ, তাঁর পিতার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেজর ছিল সাহিত্য। তাই বাড়িতে অনেক বই ছিল। পিতার সাথে তিনি অনেক বই পড়েছেন শান এবং ছুটির দিনে পিতা তাকে নিয়ে মহাপ্রাচীর, রাজপ্রাসাদ, গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে যেতেন। সেই সময় তিনি চীনা ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির আমেজ অনুভব করেন। তবে কখনো ভাবেননি যে, একদিনে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের কাজ করবেন।

বেইজিংয়ের রাজপ্রাসাদের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষ বহুবার পরিদর্শন করেন। পায়ে হেঁটেই তাঁর এই পরিদর্শন চলতো। এ কারণে প্রথম  বছরেই তাঁর একাধিক জোড়া জুতা নষ্ট হয়। রাজপ্রাসাদ বিশাল একটি জাদুঘরের মতো। এখানে হাজারটি কক্ষ রয়েছে। অতীতে মেরামত বাজেটের অভাবে অনেক কক্ষ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। জনাব শান চি সিয়াংয়ের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন কক্ষের মেরামত-কাজ শুরু হয়। পাশাপাশি, যুবক ও কিশোর-কিশোরীদের মনে রাজপ্রাসাদের প্রতি আগ্রহও সৃষ্টি করেন তিনি। ২০১৯ সালে রাজপ্রাসাদে পর্যটকদের সংখ্যা ১ কোটি ৯৩ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি ছিল, যাদের মধ্যে ৩৫ বছর বয়সের চেয়ে কম বয়সীদের সংখ্যা ছিল অর্ধেকেরও বেশি। তবে, ২০১৮ সালের আগে তাদের সংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশেরও কম।

কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীদের চীনের ঐতিহ্যিক কাপড়চোপড় পরে রাজপ্রাসাদে বেড়াতে আসতে দেখে তিনি জানতে চান: তোমরা কি শুধু রাজপ্রাসাদে আসার জন্যই এমন কাপড় পরেছো? উত্তর আসে: না, তাঁরা সাধারণ জীবনেও এমন কাপড় পরতে পছন্দ করেন।

পরে জনাব শানের উদ্যোগে ‘আমি রাজপ্রাসাদে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার মেরামত করি’ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয় এবং সেটি টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়। তখন ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সের যুবক-যুবতীদের মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি তাতে লাইক দেয়। সেই প্রামাণ্যচিত্র প্রচারের পর অনেক যুবক-যুবতী চাকরি নেওয়ার সময় রাজপ্রাসাদের কাজকে বেছে নেয়। একবার রাজপ্রাসাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার মেরামত বিভাগ মাত্র ২০ জন কর্মী নিয়োগ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আবেদনপত্র জমা পড়ে ১৫ হাজারের বেশি।

এ সম্পর্কে শান বলেন, “বর্তমানে আমাদের যুবক-যুবতীদের সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে। কারণ, চীনের সভ্যতার সুদীর্ঘকালের ইতিহাস রয়েছে। সেটি সবার জন্য গর্বের। পুরাকীর্তির সংরক্ষণ ও উত্তরাধিকার কাজের ওপর অনেক গুরুত্ব দেয় চীন সরকার। এভাবে চীনের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিও ভালো করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তা ছাড়া, বিভিন্ন জাদুঘর নিজের বৈশিষ্ট্যময় স্যুভেনির ডিজাইন করেছে, যা যুবক-যুবতীদের চাহিদা মেটায়।”

আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুরাকীর্তি সংরক্ষণসংশ্লিষ্ট একাধিক মেজর সৃষ্টি করা হয়েছে, যেমন: জাদুঘরের ডিজিটাইজিং, সাংস্কৃতিক স্যুভেনির গবেষণা ও ডিজাইন, ইত্যাদি।

চীনের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পুরস্কার বিজয়ী, স্থাপত্যবিদ উ লিয়াং ইয়োং ডক্টর শান চি সিয়াংয়ের শিক্ষক। তিনি জনাব শানের চিন্তাভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেন। শিক্ষাবিদ উ লিয়াং ইয়োংয়ের স্থাপত্যসংশ্লিষ্ট চিন্তাধারা শিখে জনাব শান নতুন ধারণার জাদুঘর গড়ে তোলেন। তিনি জাদুঘর ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করার পাশাপাশি, আরো বেশি পর্যটক আকর্ষণের জন্য রাজপ্রাসাদকে আরও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করার ওপর নজর দেন। তিনি মনে করেন, রাজপ্রাসাদকে উন্মুক্ত করতে হবে; সাধারণ মানুষের জন্য একে একটি সাংস্কৃতিক পবিত্র ভূমিতে রূপান্তরিত করা উচিত।

গত ১০ বছরে চীনাদের পুরাকীর্তি সংরক্ষণের ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পুরাকীর্তি সংরক্ষণ নয়, এটি এখন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণে পরিণত হয়েছে।

পুরাকীর্তি সংরক্ষণে কেবল আলাদা জিনিসের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেমন: গুহা ও সমাধি এবং সেখান থেকে পাওয়া বিভিন্ন প্রাচীন জিনিসপত্র। এগুলোর গভীর কোনো অর্থ আর থাকে না। কেবল গবেষণাকাজের জন্য বিশেষ তাত্পর্য রয়েছে এসবের। কিন্তু সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের ধারণা আরও বিস্তৃত। যেমন, পুরনো গ্রামের দৃশ্যও এখন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। অতীতে কেবল ক্ষুদ্র আকারের পুরাকীর্তি সংরক্ষণে কাজ করা হতো, যেমন: একটি সেতু বা প্যাগোডা। পরে ঐতিহ্যিক আবাসিক এলাকা বা নগরের সংরক্ষণ কাজেও ব্যাপক মনোযোগ দেওয়া হয়।

মোদ্দাকথা, প্রাসাদ, মন্দির, স্থাপত্য সংরক্ষণের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বাড়িঘর, গ্রামাঞ্চলের বৈশিষ্ট্যময় স্থাপত্য ও শিল্পের উত্তরাধিকারসহ বিভিন্ন সুন্দর জিনিস সংরক্ষণের ওপর মনোযোগ দেওয়া হয়।

জনাব শান এক সাক্ষাত্কারে বলেন, বর্তমানে চীনের বিভিন্ন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সাথে জড়িত বিষয় অনেক বেড়েছে। তিনিও নিজের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। যেমন, ‘জাদুঘর শহর’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বেইজিংয়ের বিভিন্ন ধরনের জাদুঘর তুলে ধরা হয়েছে। জনাব শান দর্শকদের সামনে বিভিন্ন জাদুঘরের পরিচয় তুলে ধরেছেন। তা ছাড়া, বেইজিংয়ের তুংছেং এলাকার বিভিন্ন পুরনো স্থাপত্য ও হুথুংয়ের সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় তিনি টিভি অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মজার মজার গল্প শেয়ার করেছেন।

তাঁর দৃষ্টিতে জাদুঘর এবং বিশ্বের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিকে জানার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম। জাদুঘরের বিশেষ ভুমিকা রয়েছে। প্রত্যেক দর্শক জাদুঘরের ভিতরে গিয়ে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ তাত্পর্য অনুভব করতে পারে। বিশ্বের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতিনিধি, যা মানবজাতির সম্পত্তি। সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে আরও বেশি সম্মান ও মর্যাদা পাওয়া যায়। প্রত্যেক দেশের জন্য এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

নিজের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে শান বলেন, ১৯৯৬ সালে বেইজিংয়ে ওয়েস্ট রেলস্টেশনের দক্ষিণ চত্বর নির্মাণের সময় মিং রাজবংশ আমলের নগর দেওয়াল খুঁজে পাওয়া যায়। সেই সময় গত কয়েক দশকের নির্মাণকাজের ফলে বেইজিং শহরের মিং রাজবংশের নগর দেওয়াল প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছিল। এ নগর দেওয়ালের ধ্বসাবশেষের সংরক্ষণকাজের গুরুত্বপূর্ণ তাত্পর্য রয়েছে। তবে পুরনো দেওয়াল মেরামতের জন্য বিশেষ কাঁচামাল ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রযুক্তি প্রয়োজন। তখন বেইজিং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ব্যুরো স্থানীয় গণমাধ্যমের সাথে সহযোগিতা করে সমাজের কাছে আবেদন জানায়। তারা আশা করে, বেইজিংয়ের শহরবাসীর কাছ থেকে পুরনো দেওয়ালের ইট সংগ্রহ করা যাবে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, তখন বেইজিংয়ের শহরবাসীর আন্তরিক সাড়া পাওয়া যায়। তারা নিজ নিজ বাড়িঘরের রান্নাঘর ভেঙ্গে পুরনো দেওয়ালের ইট বের করে আনেন এবং কেউ কেউ সাইকেল চালিয়ে ২৫ কেজি ওজনের ইট মেরামতস্থলে নিয়ে যান। অতীতে ইটের ওজন ছিল অনেক বেশি। একেকটার ওজন ২৫ কেজির মতো। শহরবাসীর যৌথ প্রয়াসে অবশেষে কয়েক লাখ ইট সংগৃহীত হয়। এ উদ্যোগের ফলে সমাজে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের চেতনাও সমৃদ্ধ হয়।

জনাব শান বলেন, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণে বিভিন্ন প্রজন্মের অংশগ্রহণ ও মতৈক্য প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার উপভোগের অধিকার যেমন সবার, তেমনি এগুলোর রক্ষার দায়িত্বও সবার। এ দায়িত্ব কেবল সরকার বা রক্ষণাবেক্ষণকারীদের নয়।

মিং রাজবংশ আমলের পুরাকীর্তি পার্ক ২০০৩ সালে নির্মাণকাজ শেষে খুলে দওয়া হয়। এর ইতিহাস রাজপ্রাসাদের সমান। এ পার্ক এখন বেইজিংয়ের বৈশিষ্ট্যময় দর্শনীয় স্থানগুলোর একটি।

জনাব শান চি সিয়াং এখন অবসর নিয়েছেন। তাঁর চেষ্টায় সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণেন চেতনা সমৃদ্ধ হয়েছে। এই চেতনায় এখন অসংখ্য চীনা কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতী উদ্বুদ্ধ। কেবল রাজপ্রাসাদ নয়, বেইজিং ও চীনের অন্যান্য শহরের জাদুঘর বা পুরাকীর্তি রক্ষায় অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীনারা। তাঁরা চীনা সভ্যতাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)