গত ১৬ থেকে ২২ অক্টোবর চীনের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিসি’র ২০তম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছে বেইজিংয়ে মহাগণভবনে। প্রতি পাঁচ বছর পর পর অনুষ্ঠিত এ কংগ্রেসে দেশ পরিচালনার জন্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ সব গুরুত্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। নির্বাচিত হয় পার্টির নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি। কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হওয়ার পরদিন রোববার তৃতীয় মেয়াদে সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সি চিনপিং। একই সঙ্গে তিনি কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছেন।
এবারের কংগ্রেসে চীনের বিভিন্ন প্রদেশ ও অঞ্চল থেকে বিভিন্ন মহলের ২ হাজার ২৯৬ জন প্রতিনিধি যোগ দেন। চীনের প্রেসিডেন্ট এবং সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সি চিনপিং ১৯তম সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে কংগ্রেসে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন।
প্রেসিডেন্ট সি চীনের জনগণের মঙ্গল ও জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত করার অঙ্গীকার করেন। সি বলেন, জনগণের কল্যাণসাধন শাসনের মৌলিক নীতি। জনকল্যাণ ও সুশাসন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিশ্রুতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটি উন্নত জীবনের জন্য, জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সবাইকে একসাথে কঠোর পরিশ্রম করার আহ্বান জানান পার্টির সাধারণ সম্পাদক। ২২ অক্টোবর কংগ্রেসের সমাপনী অধিবেশনেও ভাষণ দেন সি চিনপিং।
সপ্তাহব্যাপী কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট সির প্রতিবেদন ও ভাষণে চীনের ভবিষ্যত উন্নয়নের জন্য একটি পথ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে সে কথাও বলা হয়েছে।
সিপিসির ২০তম কংগ্রেস চীনের পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য কতটা তাৎপর্যপূর্ণ- এ বিষয়ে চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ ক’জন বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতি ও ব্যবসায়ী মহলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মতামত তুলে ধরে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আজকের সংবাদ পর্যালোচনায় আমরা নজর দেব বিষয়টির দিকে।
সিনহুয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেহেতু বিশ্ব অর্থনীতি এ বছর একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে, পরবর্তীতে আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাই চীনের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক তাৎপর্য বহন করে। চীনের ভবিষ্যত প্রবৃদ্ধির প্রতি তাদের আস্থা প্রকাশ করে, বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায় ও অর্থনৈতিক মহলের নেতারা বলছেন, তাদের বিশ্বাস চীনের আধুনিকীকরণের অগ্রগতি এবং উদ্ভাবন-চালিত প্রবৃদ্ধি বিশ্ব অর্থনীতির জন্যও অধিকতর নিশ্চয়তা বয়ে আনবে।
সিপিসি কংগ্রেসে প্রতিবেদন পেশ করার সময় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং বলেন, চীন একটি নতুন উন্নয়ন প্যাটার্ন তৈরি ত্বরান্বিত করবে এবং উচ্চমানের উন্নয়ন সাধন করবে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রবাহের মধ্যে ইতিবাচক আন্তঃক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন প্রেসিডেন্ট সি। তাই দেশীয় অর্থনীতির ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ করলেও উচ্চমানের উন্মুক্তকরণেও জোর দেওয়ার কথা বলেন চীনা প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট সি’র বক্তব্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে নেতৃস্থানীয় থাই কাসিকর্ন ব্যাঙ্কের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট উইচাই কিনচং চোই বলেছেন, তিনি দেখতে পাচ্ছেন যে, চীনের ভবিষ্যত উন্নয়নের দিকটি উচ্চ-মানের এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে আরও বেশি ফোকাস করছে। এটি থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য ভাল খবর।
সিনহুয়ার প্রতিবেদন বলছে, গত এক দশকে চীনের মোট দেশজ উৎপাদন বিশ্ব অর্থনীতির ১৮.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এটি ১৪০টিরও বেশি দেশ এবং অঞ্চলের জন্য একটি প্রধান ব্যবসায়িক অংশীদার হয়ে উঠেছে, যা পণ্যের মোট বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে, চীন, যেটি মহামারী নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমন্বয় করতে পেরেছে, এখনও বিশ্বব্যাপী সরবরাহ এবং শিল্প চেইনের একটি স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জার্মান বহুজাতিক সফ্টওয়্যার কোম্পানি SAP SE-এর গ্লোবাল এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং SAP গ্রেটার চায়না’র প্রেসিডেন্ট চেনহং হুয়াংয়ের দৃষ্টিতে, চীনের সবুজ উন্নয়ন বৈশ্বিক শক্তি, পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে।
বিদেশী বিনিয়োগের সুবিধার্থে চীনা সরকারের প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে চীনের প্রথম সম্পূর্ণ বিদেশী মালিকানাধীন অটো এন্টারপ্রাইজ টেসলার ভাইস প্রেসিডেন্ট তাও লিন বলেছেন, মার্কিন কোম্পানি চীনা বাজারে তার উপস্থিতি আরও প্রসারিত করতে চাইছে।
অর্থনৈতকি উন্নয়নে চীন তার পরিকল্পনায় উদ্ভাবনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সংস্থা জানিয়েছে, দেশটি গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স ২০২১-এ ১২তম স্থানে উঠে এসেছে। ২০১২ সালে যেখানে চীনের অবস্থান ছিল ৩৪-এ। মধ্যম আয়ের অর্থনীতির মধ্যে এটি প্রথম স্থানে। এ থেকে চীনের উদ্ভাবনের গতিপ্রকৃতি অনুমান করা যায়।
কংগ্রেসে প্রতিবেদন সি চিন পিং যথার্থই বলেছেন, ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আমাদের প্রাথমিক উৎপাদন শক্তি, প্রতিভাকে আমাদের প্রাথমিক সম্পদ হিসাবে এবং উদ্ভাবনকে আমাদের বৃদ্ধির প্রাথমিক চালক হিসাবে বিবেচনা করতে হবে’।
ফরচুন গ্লোবালের শীর্ষ ৫০০ কোম্পানির তালিকায় চীনা কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে। ২০১২ সালে যেখানে ৯৫টি চীনা কোম্পানি এ তালিকায় স্থান পেয়েছিল সেখানে ২০২১ সালে ১৪৫টি চীনা কোম্পানি তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
মেক্সিকোতে একটি কৃষি-উৎপাদনকারী রাজ্য জলিসকোর অসওয়াল্ডো নাভারো চীন থেকে বেশ কয়েকটি কৃষি সরঞ্জাম কিনেছেন। তিনি সিনহুয়াকে বলেছেন যে, চীন থেকে তিনি যে বীজ পরিষ্কারের মেশিনটি আমদানি করেছেন তার দৈনিক ক্ষমতা অন্যান্য দেশের যন্ত্রপাতির চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি। এটি অনেক সময় এবং খরচ সাশ্রয় করে।
চীনা অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উদ্ভাবন ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতি ও মানব সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এটা জোর দিয়ে বলা যায়।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।