আকাশ ছুঁতে চাই পর্ব ৯৬
2022-10-20 15:29:33

কী রয়েছে এবারের পর্বে

১. এখন পর্যন্ত আমার সব ছবিই নারীকেন্দ্রিক: অপরাজিতা সংগীতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা

২. মায়ের মতো শিক্ষক

৩. পেশাদার বক্সিংয়ে শুরু হলো নারীর জয়যাত্রা

৩. নারীর অংশগ্রহণে জমজমাট সাংহাই  ফ্যাশন উইক

৪.  গ্রামের দারিদ্র্য দূর করেছেন লু সিউসিং

 

চীন আন্তর্জাতিক বেতারের ঢাকা স্টেশন থেকে প্রচারিত আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। কেমন আছেন আপনারা? আশাকরি ভালো আছেন। আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানে আমরা সবসময় কথা বলি নারীর সাফল্য, সংকট, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে।

এখন পর্যন্ত আমার সব ছবিই নারীকেন্দ্রিক: অপরাজিতা সংগীতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা

নারী অধিকার নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে এরমধ্যেই খ্যাতি ও সম্মান পেয়েছেন অপরাজিতা সংগীতা। আজ আমাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন তিনি। তার কাছ থেকে শুনবো চলচ্চিত্র নির্মাণে অভিজ্ঞতার কথা। আমাদের অনুষ্ঠানে তাকে স্বাগত জানাই।

সাক্ষাৎকার:

অপরাজিতা সংগীতা কখনও ভাবেননি তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। অনেকটা আকস্মিকভাবেই তার এ পেশায় আসা। তিনি নারীবাদী অ্যাকটিভিস্ট। শাহবাগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন সক্রিয়ভাবে। লেখালেখি করেছেন বিভিন্ন স্থানে। একসময় তার মনে হয়, নারীদের অধিকারের কথা, বৈষম্যের কথা, নির্যাতনের কথা তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরবেন। সেই চিন্তা থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেন।

 

অপরাজিতা সংগীতার প্রথম চলচ্চিত্র ‘পুরুষাতঙ্ক’। এই শর্ট ফিল্মে তিনি সমাজে একজন নারীকে চলার পথে কত রকম বিরুপ পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে চলতে হয় তা তুলে ধরেছেন। সংগীতা বলেন, ‘একজন নারীকে যৌন হয়রানির ভয়, ধর্ষণের শিকার হওয়ার ভয়, আরও নানা রকম আতঙ্কে জীবন পার করতে হয়। এই বিরুপ পরিস্থিতিই তুলে ধরতে চেয়েছি।’ তার আরেকটি চলচ্চিত্র ‘রিভোল্ট’। ‘ছাড়পত্র’ চলচ্চিত্রে তিনি বলেছেন ‘এই সমাজে আমি কখনও সন্তানের জন্ম দিবো না।’

সমাজে নারীর প্রতি বিভিন্ন বৈষম্য তুলে ধরেছেন সংগীতা। তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। এজন্য অনেক পুরস্কার ও সম্মাননাও পেয়েছেন তিনি। দেশীবিদেশী প্রায় ২৮টি পুরস্কার ঝুলিতে ভরেছেন তিনি। তবে যখন কেউ তার নির্মিত চলচ্চিত্র দেখে বলে, ‘এমন ছবি আরও হওয়া দরকার’ সেটিকেই সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করেন তিনি। শুধু নারীরা নয়, পুরুষরাও তার চলচ্চিত্র দেখে নারী-অধিকার বিষয়ে সচেতন হয়।

তিনি ট্রান্সজেন্ডারদের বিষয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। এখন এলজিবিটি অধিকার নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন। আগামি বছর পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে হাত দিবেন তিনি।

সমাজে নারীর প্রতি সংঘটিত সকল প্রকার সহিংসতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান সংগীতা। তিনি আগামিতে নারীর সাফল্য ও অর্জনও তুলে ধরতে চান।

চলচ্চিত্র নির্মাণের পেশায় নারীর প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়েও জানালেন তিনি। প্রথমত ‘পরিচালক হিসেবে যখন দেখে একটা মেয়ে বসে আছে’ তখন তার নির্দেশ সহজে মান্য করতে চায় না। এটা প্রথম চ্যালেঞ্জ। তবে যত বাধাই থাকুক সেসব মোকাবেলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে দৃঢ় প্রত্যয়ী তিনি।

 

 

মায়ের মতো শিক্ষক

খ্যাতি বা অর্থ উপার্জন নয়, তার ইচ্ছা ছিল শিশুদের শিক্ষায় অবদান রাখার। আর সেকাজটি সাফল্যের সঙ্গে করে হাজারো মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। এমনি একজন শিক্ষক হুয়াং চুনছিয়ং। এই নারী তার এলাকার শিশুদের কাছে পেয়েছেন মায়ের মর্যাদা। চলুন শোনা যাক তার কথা।

চীনের একটি ছোট শহরের একজন শিক্ষক। বড় শহরে বেশি বেতনের কাজের সুযোগ পেয়েও নেননি তিনি। ফিরে এসছেন নিজের হোমটাউনে। তারপর তিন দশক ধরে তিনি শিক্ষকতা করছেন। মায়ের মতো স্নেহ ও যত্ন দিয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন শিশুদের।

এই শিক্ষকের নাম হুয়াং চুনছিয়ং। তিনি চীনের কুইচোও প্রদেশের চেনইউয়ান কাউন্টির চিয়ানকু টাউনের বাসিন্দা। এই ছোট্ট শহরের সেন্ট্রাল এলিমেন্টারি স্কুলের শিক্ষক তিনি। বলেন, ‘আমি বড় হয়েছি গ্রামে। আমার বাবা ছিলেন গ্রামের শিক্ষক। আমি ছোটবেলা থেকে গ্রামের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি।’

১৯৯২ সালে গ্র্যাজুয়েশনের পর তিনি বড় শহরে ভালো বেতনে কাজের সুযোগ পান। কিন্তু তিনি ফিরে আসেন হোমটাউনে। এখানে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকতার ভার নেন।

তিনি ত্রিশ বছর ধরে কাজ করছেন। এখানকার অনেক ছাত্রছাত্রী তার অনুপ্রেরণায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বড় বড় শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

তাদের সকলের কাছেই তিনি মায়ের মতো। তিনি ক্লাসে ও ক্লাসের ফাঁকে মায়ের মতো যত্ন নিয়ে শিশুদের দেখাশোনা করেন। তাদের শিক্ষা গ্রহণকে আনন্দময় করে তোলেন। শিশুরাও একবাক্যে বলে, ‘তিনি একজন সেরা শিক্ষক।’

২০১৬ সালে তিনি প্রাথমিক শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নে ওয়ার্কশপের আয়োজন করেন। তিনি গ্রামশিক্ষকদের জন্য একটি প্লাটফর্মও প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর মাধ্যমে শিক্ষকরা পরষ্পরের সঙ্গে অভিজ্ঞতার বিনিময় করতে পারেন। নিজেদের দক্ষতার উন্নয়নও করতে পারেন।

 

পেশাদার বক্সিংয়ে শুরু হলো নারীর জয়যাত্রা

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পেশাদার বক্সিংয়ে নারীর অংশগ্রহণ শুরু হলো। সম্প্রতি বাংলাদেশ বক্সিং ফেডারেশনের উদ্যোগে নারীদের জন্য পেশাদার বক্সিংয়ের আয়োজন করা হয় ঢাকার পল্টনে মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়ামে। এর আগে বক্সিং ফেডারেশন আরও দুটি পেশাদার বক্সিং আসর বসিয়েছিল। কিন্তু সে দুটি ছিল পুরুষদের। এই সপ্তাহেই প্রথম নারীদের জন্য পেশাদার বক্সিং আয়োজিত হয়। বাংলাদেশের প্রথম দুই পেশাদার নারী বক্সার শামীমা আক্তার ও সানিয়া সুলতানা রিংয়ে নামেন। সানিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন শামীমা।

 

শামীমা আক্তার ২০১২ সাল থেকে বক্সিং করছেন। ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি টানা জাতীয় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন।

জাতীয় প্রতিযোগিতা, আন্তসার্ভিস, বাংলাদেশ গেমসসহ অন্যান্য ঘরোয়া টুর্নামেন্টে ৫১ কেজি ওজন শ্রেণিতে ৭ বার হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন।

 

নারীর অংশগ্রহণে জমজমাট সাংহাই  ফ্যাশন উইক

চলতি বছরের শুরুতে কোভিড-১৯ এর ধকল সামলে নিয়ে আবারো সাংহাইয়ের সব ধরনের কার্যক্রম চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে সাংহাই ফ্যাশন উইক শো-২০২৩। এতে পোশাকের একাধিক ডিজাইন উন্মোচন করা হয়। তবে এবারের ফ্যাশন শোতে চীনের সব নামিদামি নারী র‌্যাম্প মডেলরা অংশ নেন। ইভেন্ট  চলাকালে বাণিজ্য মেলা এবং শিল্প ফোরামও অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তাহব্যাপী চলে এ আয়োজন। বিস্তারিত থাকছে রিপোর্টে।

সৃজনশীল বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাকে সাংহাই ফ্যাশন উইকের মঞ্চে র‌্যাম্পে হাটছেন নামীদামী নারী সুপার মডেলরা।

 

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বসন্ত/গ্রীষ্মকালীন সাংহাই ফ্যাশন উইক শো-২০২৩। এবারের শো যেহেতু দুই ঋতু-নির্ভর তাই আবহাওয়ার পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে সামঞ্জস্যপূর্ণ একাধিক ডিজাইন প্রদর্শিত হয়। এক্ষেত্রে ফিউশন থিমকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। 

এ বছরের শুরুতে চীনের সাংহাইয়ে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। সব ধরনের কার্যক্রমে আসে স্থবিরতা। তবে সেই ধাক্কা খুব দ্রুত সামলে নিয়েছে দেশটির সরকার। জীবনযাপনে ফিরেছে স্বাভাবিকতা। সরগরম হয়ে উঠেছে সব ধরনের কার্যক্রম। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে আবারো শুরু হওয়া এ সপ্তহাব্যাপী ফ্যাশন শো’ বেশ জমে উঠেছিল। বিখ্যাত সুপার মডেলদের পদচারণায় অনুষ্ঠানস্থল ছিল জমজমাট।

বিখ্যাত নারী মডেল-ফ্যাশন ডিজাইনার লিউ ইয়ান তার সবশেষ উদ্ভাবনী ডিজাইনে পোশাক প্রদর্শনের সময় ব্যবহার করেন আফ্রিকা, ভারত ও চীনের মিউজিক।  তিনি বলেন, "ভাইরাস-প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা পূরণসহ এই শোটি করার জন্য আমাদের উপর অনেক চাপ ছিল। আমি এখানে এসে শোটি উপস্থাপন করতে পেরে খুশি। এটি একটি দুর্দান্ত শুরু।’

এর আগে শরৎ/শীতকালীন সাংহাই ফ্যাশন উইক-২০২২ অনুষ্ঠিত হয় অনলাইনে, যা ডিজাইনার ও ক্রেতাদের জন্য খানিকটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। এবারের আয়োজন অফলাইন বা সরাসরি অনুষ্ঠিত হওয়ায় উভয়ের মধ্যেই ছিল সন্তুষ্টির ঢেঁকুর।  একজন দর্শক বলেন,  ‘নতুন ডিজাইনের টেক্সচার ও স্টাইল দেখতে বেশ ভালো। সরাসরি পোশাক ভালোভাবে দেখে কিনতে পারছি আমরা। কিন্তু অনলাইন ভিডিওতে এতো কিছু বোঝা যায় না।’

সাংহাই ফ্যাশন উইকের আয়োজনে অংশ নিতে পেরে খুশি অংশগ্রহণকারীরাও।

চীনে ২০০৩ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে সাংহাই ফ্যাশন উইক। ঠিক তখন থেকেই এটি এশিয়ার বৃহত্তম ফ্যাশন ইভেন্টগুলোর মধ্যে একটি হয়ে উঠেছে। একই ইভেন্টে একই সময়ে বাণিজ্য মেলা এবং শিল্প ফোরামও অনুষ্ঠিত হয়। গত মাসের ২২ তারিখ শুরু হয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হয় পুরো আয়োজন।

 

গ্রামের দারিদ্র্য দূর করেছেন লু সিউসিং

সিপিসির ২০তম  ন্যাশনাল কংগ্রেসে দেশের বিভিন্ন প্রদেশ ও অঞ্চল থেকে যোগ দিয়েছেন প্রতিনিধিরা।  এদের মধ্যে রয়েছেন অনেক নারী। এই নারীরা প্রত্যেকেই গ্রাম উন্নয়নে নিরলস ভূমিকা রেখেছেন। চলুন প্রতিবেদনে  শোনা যাক এমন একজন নারী  লু সিউসিংয়ের কথা।

কুয়াংতুং প্রদেশের ফোশান শহরের কাছে কুচাও গ্রাম। এই গ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ লু সিউসিং। তিনি গ্রামের কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি। এই গ্রামের দারিদ্র্য মুক্তিতে প্রধান অবদান রেখেছেন লু।

৩৮ বছর বয়সী লু যখন প্রতিদিন সকালে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে পরিদর্শন করেন তখন গ্রামবাসীরা হাসিমুখে তাকে স্বাগত জানায়, যে কোন বিষয় নিয়ে পরামর্শ করে এবং তাদের সব সমস্যা তুলে ধরে।

২০০৩ সালের মে মাসে লু কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। শহরাঞ্চলে উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের প্রলোভন ছেড়ে তিনি চলে যান গ্রামীণ এলাকায় গ্রাম উন্নয়ন কাছে যোগ দিতে ২০১৪ সালে । তিনি সে সময় তৃণমূল পর্যায়ে কাজ শুরু করেন। বাইরে থেকে আসা একজন নারীকে গ্রামবাসীর নিজেদের মানুষ হিসেবে মেনে নিতে প্রথমে একটু দ্বিধা ছিল। কিন্তু লু আন্তরিক শ্রমে অচিরেই নিজের অবস্থান গড়ে নেন। ২০১৭ সালের এপ্রিলে তিনি কুচাও গ্রামের পার্টি সেক্রেটারির পদ পান। তিনি কারখানা স্থাপনকারী কোম্পানি ও গ্রামবাসীর মধ্যে একটি দ্বন্দ্বের মিমাংসা করেন সাফল্যের সঙ্গে। গ্রামবাসীরা তাদের জমি কারখানার কাছে ভাড়া দিয়ে নিজেদের আয় বৃদ্ধি করে।

কয়েক বছরের শ্রমের পর দেখা যায় গ্রামের বার্ষিক আয় ৬৮.৬ মিলিয়ন ইউয়ান থেকে বেড়ে ১০০ মিলিয়ন ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে।

কোভিড ১৯ মহামারীর সময় গ্রামে তার সাহসী ভূমিকার জন্য সম্মাননাও লাভ করেন লু। বর্তমানে কুচাও গ্রাম পুরো ফোশানে মডেল গ্রামের মর্যাদা পেয়েছে।

২০তম ন্যাশনাল কংগ্রেসে প্রতিনিধি হিসেবে যোগও দিয়েছেন লু। লু এর মতো সাহসী ও পরিশ্রমী নারী গ্রাম উন্নয়নে ভূমিকার জন্য সকলের অনুসরণীয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন।