চীনের গ্রামাঞ্চলের যুব শিক্ষক ইয়ান স্যু তুংয়ের গল্প
2022-10-17 15:51:47

চীনের গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয় চীনা সরকার। তাই আরও বেশি তরুণ ও দক্ষ শিক্ষককে গ্রামাঞ্চলে চাকরি করতে বিভিন্ন উত্সাহব্যঞ্জক ও সুবিধাজনক নীতি চালু করেছে সরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থী গ্রামাঞ্চলের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন এবং তাদের যৌথ প্রয়াসে গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের শিক্ষাজীবন আরও উন্নত ও মজার হয়েছে।

শিক্ষক ইয়ান স্যু তুং তাদের মধ্যে একজন। তিনি চীনের হ্যপেই প্রদেশের চাংচিয়াখ্য শহরের জুলু জেলার একটি বোর্ডিং স্কুলের প্রেসিডেন্ট ও চীনা ভাষার শিক্ষক। ছোটবেলা থেকে তিনি শহরে বড় হয়েছেন। কোনোদিন গ্রামাঞ্চলের শিক্ষক হবেন—এমনটা কখনও ভাবেননি। অথচ টানা ৭ বছর ধরে এখানকার প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করছেন তিনি। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা শিক্ষক ইয়ানের গল্প তুলে ধরবো এবং ডিম প্যানকেক দোকানের ছেলে পেং সিয়াং ইয়ুর পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির গল্পও শেয়ার করবো।

২০১৫ সালে চীনের হ্যনান প্রদেশের শাংছিউ একাডেমি থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি গ্রামাঞ্চলের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। যদিও গ্রামাঞ্চলের দুর্বল পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, তবে প্রথমবার স্কুলে পৌঁছে তিনি অবাক হন। কারণ, তিন তলার একটি শিক্ষাভবন ছাড়া, আশেপাশে তেমন কিছু নাই। বৃষ্টি হলে স্কুলের বিভিন্ন এলাকা কর্দমাক্ত হয়ে যায়।

শিক্ষক ইয়ানের সাথে আরও কয়েকজন যুব শিক্ষক চুলু জেলার এ বোর্ডিং স্কুলে আসেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হোস্টেলভবনের দৃশ্য দেখে কান্নাকাটি শুরু করেন। সেই স্কুলে শুরুতে তিনিও হতাশ ছিলেন। গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তাও তাঁর মাথায় এসেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি বড় শহরে ফিরে যাননি, বরং শিক্ষকতা চালিয়ে যান।

স্কুলে আসার পর শিক্ষক ইয়ান চতুর্থ শ্রেণীর দুটি ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের চীনা ভাষার ক্লাস নিতে শুরু করেন। যদিও তখন তিনি স্কুল ত্যাগ করার পরিকল্পনা করছিলেন, তবে ক্লাসে মনোযোগ দিয়েই শিক্ষার্থীদের পড়াতেন। এক বছর পর স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ক্লাস নেওয়ার দায়িত্ব পান তিনি। তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা অনেক দুঃখ পায়। কারণ, শিক্ষক ইয়ানের ক্লাস তাদের জন্য মজার ছিল। সবার চীনা ভাষার পরীক্ষার মান উন্নত হয় তখন।

এ সম্পর্কে শিক্ষক ইয়ান বলেন, “আমাদের স্কুল একটি বোর্ডিং স্কুল। সবাই একসাথে থাকা-খাওয়ার কাজ সারে। পরিবারের সদস্যদের মতো।” তিনি চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের বলেন, তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীর ক্লাসশেষে তাদের ক্লাসে আসবেন।

এভাবে আরও ৬ বছর অতিক্রান্ত হয়। শিক্ষক ইয়ান আরও অনেক ছাত্রছাত্রীর স্নাতক হবার স্বাক্ষী হন। তিনি এখনো স্কুলে পড়াচ্ছেন। অন্যান্য স্কুলে চাকরির আবেদনের সুযোগ তাঁর ছিল। কিন্তু তিনি এ স্কুলের মায়া ত্যাগ করতে পারেননি।

চীনা ভাষা শেখার কাজ আরো মজার করার জন্য তিনি অনেক নতুন বিষয় যুক্ত করেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ডাবিং, নাটকের অভিনয় আর কবিতার জন্য ছবি আঁকাসহ বিভিন্ন নতুন বিষয় তাঁর ক্লাসে নিয়ে আসেন। মাঝে মাঝে তিনি বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে ক্লাস করেন। বাচ্চাদের শরত্কালের গাছ, মেঘ, পাখি ও অদূরের পাহাড় অনুভব করার সুযোগ দেন। শরত্কাল নিয়ে বাচ্চাদের লিখতে উত্সাহিত করেন। বাচ্চারা গাছপাতা,পাখির বাসা পর্যবেক্ষণ করা শেখে এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রাণচঞ্চল লেখাও রচনা করা শেখে।

শিক্ষক ইয়ানও স্কুলকে নিজের বাড়ি হিসেবেই দেখেন। ছোট বাচ্চাদের কাপড়চোপড় ধুয়ে দেন; কেউ অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে জেলার হাসপাতালে যান। হাসপাতাল থেকে চিকিত্সার পর আবার বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে ফিরে আসেন। ধীরে ধীরে তিনি বাচ্চাদের অসুস্থতার কারণও কিছুটা বুঝতে শেখেন। তিনি কৌতুক করে বলেন, তিনি অর্ধেক ডাক্তারে পরিণত হয়েছেন।

তা ছাড়া, বাচ্চাদের জন্য কাপড়চোপড় সেলাই করা, মেয়েদের বিনুনি তৈরি করে দেওয়া এবং ছাত্রছাত্রীদের চুল কাটাসহ অন্যান্য কাজও করেন তিনি। বাচ্চাদের সাথে থাকা- খাওয়ার জন্য তিনি জীবনের অনেক নতুন দক্ষতা শেখেন।

শিক্ষক ইয়ানের ক্লাসে একজন ছেলের নাম চিয়ানছিয়াং। তাঁর ছোটবেলায় মা তাকে ছেড়ে চলে যায় এবং বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তাই এ ছেলের চরিত্র অন্যান্য বাচ্চার চেয়ে আলাদা। তার অবস্থা জানার পর শিক্ষক ইয়ান বিশেষভাবে এ ছেলের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি প্রায়ই তার ব্যাগে স্টেশনারি ও অল্প টাকা রেখে দিতেন। ছেলে চিয়ানছিয়াংয়ের পায়ে ফোসকা পড়ে। তাই শীতকালে তার জন্য কষ্টকর সময়। শিক্ষক ইয়ান তার পায়ে বিশেষ মলম মাখিয়ে দেন এবং প্রতিদিন গরম পানি দিয়ে তার পা ধুয়ে দেন। ছেলে চিয়ানছিয়াং ফুটবল খেলতে পছন্দ করে। তাই তিনিও তার সাথে ফুটবল খেলেন।

একদিন চিয়ানছিয়াং শিক্ষক ইয়ানের জন্য অনেক এলমান্ড বাদাম কিনে আনে। সে বলে, ‘আমি জানি আপনি এলমান্ড খেতে পছন্দ করেন। আমি হাতুড়ি দিয়ে সব এলমান্ড খুলে দিয়েছি। এখন সহজে খেতে পারবেন।’ সেদিন শিক্ষক ইয়ানের জন্মদিন ছিল। ছেলে চিয়ানছিয়াংয়ের উপহার তাঁকে আনন্দিত করে।

আরও কয়েক বছর পরের কথা। তখন চিয়ানছিয়াংয়ের বাবা মারা গেছেন এবং সে কারিগরি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আরও পরে পায় চাকরি। প্রথম মাসের বেতন দিয়ে সে শিক্ষক ইয়ানের জন্য এক জোড়া জুতা কেন। সে বলে, শিক্ষক ইয়ান যেন তার বাবার মতো। যখন বাবাকে মিস করে, তখন ইয়ানের সাথে ফোনে কথা বলে।

গত কয়েক বছরে শিক্ষক ইয়ান এবং তাঁর সহকর্মীদের যৌথ প্রয়াসে স্কুলে একটি ছবি স্টুডিও স্থাপিত হয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য ছবি তোলেন তাঁরা। সেটিও বাচ্চাদের জন্য খুব আনন্দের ব্যাপার। তা ছাড়া, বিভিন্ন দাতব্য কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় স্কুলে। শিক্ষকরা ক্যালিগ্রাফি, কবিতা আবৃত্তি, হারমোনিকা বাজানো, রোলার স্কেটিং করা, কাগজ কাটা ও চারুকলাসহ বিভিন্ন ক্লাসের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেন।

শিক্ষক ইয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার আগে তাঁর শিক্ষক তাঁকে একটি কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভালোবাসা ও আন্তরিকতাসহ কাজ করতে হবে। এ কথা স্মরণ করে ইয়ান স্যু তুং বলেন, “আমি শিক্ষকের প্রত্যাশামতো কাজ করার চেষ্টা করি।”

২০২০ সালে ২৯ বছর বয়সের শিক্ষক ইয়ান স্যু তুং চীনের হ্যপেই প্রদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন এবং উচিয়াকৌ জেলার বোর্ডিং স্কুলের প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর পদোন্নতি হয়। তখন তিনি বলেন, “আমি জানি, গত কয়েক বছরের যাত্রা কতো কষ্টকর ছিল। তবে, ভবিষ্যতে আমি আরও সুন্দর স্কুল নির্মাণের জন্য অব্যাহতভাবে প্রচেষ্টা চালাবো।”

 

প্যানকেক দোকানের ছেলে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো

সম্প্রতি চীনের ইন্টারনেটে একটি গল্প ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। চীনের হ্যনান প্রদেশের লুওশান জেলার একটি ডিমের প্যানকেকের দোকানদারের গল্প সেটি। একদিন দোকানের সামনে একটি স্লোগান লেখা কাগজ লক্ষ্য করলেন ক্রেতারা: ‘আমার ছেলে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। আমরা তাকে বেইজিংয়ে পাঠিয়েছি। তাই দোকান সাময়িকভাবে বন্ধ। তবে, সবাইকে মিষ্টিমুখ করার জন্য আহ্বান জানাই।”

পেং ইয়োং এ দোকানের মালিক। তাঁর ছেলে পেং সিয়াং ইয়ু সেপ্টেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। গত কয়েক মাসে পেংয়ের দোকান ছিল অনেক ব্যস্ত। কারণ, ছেলের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুখবর আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে তার দোকানে আসতে ও তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চায়।

ছেলের কথা ভেবে দোকানদার পেং অনেক গর্বিত। তিনি বলেন, “আমার ছেলে ছোটবেলা থেকে ভালো করে লেখাপড়া করে আসছে। তাই সে অবশেষে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছে। আমরা অনেক খুশি।” পেং ও তাঁর স্ত্রী চাও জুন যুবকাল থেকে ডিমের প্যানকেক তৈরি করা শুরু করেন। তাঁরা ছেলেকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর পর, দোকানও সাময়িকভাবে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে চালু করেন। এ জাতীয় দিবসের ছুটিতে জনাব পেং ইয়োংয়ের দোকান পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় দোকানে পরিণত হয়। অনেক লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর রান্না করা ডিমের প্যানকেক খেতে আগ্রহ দেখায় শিক্ষার্থীরা। অনেকে বলে, অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করেও খেতে পায়ইনি। কারণ, লোক অনেক বেশি।

ম্যাডাম চাও জুন যুবকালে ট্রাইসাইকেল চালিয়ে স্বামী পেং ইয়োংয়ের সাথে বেইজিংয়ের রাস্তায় ডিমের প্যানকেক বিক্রি করেছেন। পরে ছোট ছেলে পেং সিয়াং ইয়ু’র বড় ভাইয়ের ছেলে অর্থাত্ তাদের নাতীর জন্ম হয়। ফলে দু’জন জন্মস্থানে দোকান চালু করেন। তারা এ ব্যবসার আয় দিয়ে ছেলেদের পড়াশোনার খরচ বহন করেছেন।

অনেক নেটিজেন ওয়েবসাইট থেকে তাদের গল্প জানতে পেরেছেন। তাঁরা এ পরিশ্রমী দম্পতির প্রতি সম্মান প্রকাশ করেন। তাঁরা মনে করেন, এই দম্পতি আন্তরিক ও পরিশ্রমী। তাঁরা নিজেদের প্রচেষ্টায় ছেলেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। এটি বেশ গর্বের ও উত্সাহের ব্যাপার।

যদিও পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে দোকান চালু করেছেন দোকানদার পেং, তবে ছেলের সাথে তাদের দেখা হয় খুব কমই। তাদের ছেলে কম কথা বলে। প্রতিদিন লেখাপড়ার জন্য ব্যস্ত থাকে। তবে সে প্রতিদিন বাবা-মাকে ফোন করে। তার পড়াশোনা ও স্নাতক হওয়ার পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়ে বাবা মায়ের সাথে আলাপ করে। দোকানদার পেং আশা করেন, তার ছেলে স্নাতক হওয়ার পর দেশের উন্নয়নে নিজের অবদান রাখতে পারবে।

যুবকাল থেকে দুটি ছেলের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি ডিমের প্যানকেক বিক্রি করে আসছেন পেং। শুরুতে ২০০০ সালে একটি ডিমের প্যানকেকের দাম ছিল মাত্র ২ ইউয়ান। তারা বেইজিংয়ে একটি ছোট বাড়িতে থাকেন।

বড় ছেলে লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো করতে পারেনি।  ২০০৬ সালে ছোট ছেলে পেং সিয়াং ইয়ুর জন্ম হয়। তখন তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, কষ্ট করে হলেও বাচ্চাদের লেখাপড়া ভালোভাবে করাবেন। তখন তারা লুওশান জেলায় ফিরে যান এবং ছোট ছেলেও জন্মস্থানে পড়াশোনা শুরু করে। ছোট ছেলে লেখাপড়ায় বেশ দক্ষ এবং স্কুল থেকে বাসায় ফিরে বাবা-মাকে সহায়তাও করতো। দোকানের বিভিন্ন কাজে সেও সাহায্য করতো। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে সে অস্থায়ী চাকরি নেয় এবং মাসিক বেতন ১৫০০ ইউয়ান হলেও ১০০০ ইউয়ান মাকে দেয়।

পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়া ছিল পেং সিয়াং ইয়ু’র স্বপ্ন। বর্তমানে সে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নিজের লেখাপড়ার খরচ বহন করতে সেও অস্থায়ী চাকরি নিয়েছে। দরিদ্র পরিবারের বাচ্চারা অন্যদের চেয়ে আরো ভালো করে বাবা-মায়ের কষ্ট বুঝতে পারে। আশা করি, ছেলে পেং সিয়াং ইয়ু’র ভবিষ্যতের জীবন আরও সুন্দর হবে।(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)