ফিলিপিন্সের লুজন দ্বীপের উত্তরাঞ্চল দেশটির গুরুত্বপূর্ণ “খাদ্যশস্য গুদাম” হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আধুনিক সেচ ব্যবস্থার অভাবে স্থানীয় কৃষকরা শুধু প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেন। ফসলের উৎপাদনও ভাল হয় না। কিন্তু, এ পরিস্থিতি খুব শীঘ্রই পরিবর্তন হবে। কারণ চীনা প্রযুক্তি দিয়ে নির্মিত চিকো নদী সেচ প্রকল্প সেখানকার ভূমির জন্য জীবনের উৎস ডেকে আনবে।
ফিলিপিন্সের কলিঙ্গ প্রদেশের পিনোকোক গ্রামের প্রধান সোডানিমো টমডগ একটি অনাবাদী জমি দেখাচ্ছেন। চীনা প্রতিষ্ঠানের নির্মিত চিকো নদীর সেচ প্রকল্প চালু হবার খবর শুনে গ্রামের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করতে শুরু করেন তিনি। তিনি বলেন, নদীর পানি গ্রামের শাখা চ্যানেলে আসলে অনাবাদী জমি অবিলম্বে সমৃদ্ধ একটি উর্বর মাঠে পরিণত হবে।
তিনি বলেন, আগে শুধু বর্ষাকালে চাষ করা যেত। বছরে শুধু এক ঋতুতে ফসল পাওয়া যেত। আর তাও যথেষ্ট বৃষ্টি হলে ঘটত। অনাবৃষ্টিতে ফসল হত না। সুতরাং, চিকো নদীর সেচ প্রকল্প একটি বিরাট অগ্রগতি। বিশেষ করে আমাদের গ্রামবাসীদের জন্য। আমরা সেচ ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে জীবন উন্নত করতে পারব। ফলন আরও ভাল হবে।
এ গ্রামের আশপাশের এলাকায় “চিকো নদীর সেচ প্রকল্প” সম্পর্কে সবাই জানে। উত্তর লুজন দ্বীপের চাগায়ান ও কলিঙ্গ প্রদেশ দেশটির বিখ্যাত “খাদ্যশস্য গুদাম” হিসেবে পরিচিত এবং ধান ও ভুট্টার প্রধান উত্পাদন অঞ্চল। অঞ্চলটির প্রধান পানির উৎস চিকো নদী। কলিঙ্গ জাতি চিকো নদীকে “জীবনের নদী” বলে গণ্য করে। কিন্তু চিকো নদী নিচু এবং অধিকাংশ কৃষি জমি তুলনামূলকভাবে উঁচুতে অবস্থিত হওয়ার কারণে নদী থেকে পানি পাওয়া মুশকিল। ২০১৮ সালে চীনা প্রতিষ্ঠান চিকো নদীর সেচ প্রকল্প নির্মাণ শুরু করে। সেখানকার কৃষকরা চিকো নদীকে সত্যিকারের “জীবনের উৎসে” পরিণত করার আশা দেখছে।
চিকো নদীর সেচ ব্যবস্থার প্রধান প্রকল্প--পাম্প স্টেশন--ছাড়া ৩০ কিলোমিটার প্রধান চ্যানেল, ৭০ কিলোমিটার শাখা চ্যানেল এবং চ্যানেলের আনুষঙ্গিক গঠন উপাদান ৪৯০টি। এসব চ্যানেল রক্তনালীর মত কৃষি জমিতে প্রবেশ করে আশপাশের ৮ হাজার ৭শ’ হেক্টর জমির জন্য পুষ্টি জোগাবে এবং শুকনো মৌসুমে ফসলের উত্পাদন পরিমাণ বাড়াবে। নিকটবর্তী ২২টি গ্রামের প্রায় ৫ হাজার কৃষক পরিবার এ থেকে লাভবান হবে।
একই সময় উত্পাদন পরিমাণ বেড়ে প্রতিবছর ফিলিপিন্সের চাল আমদানির ব্যয় কমাবে প্রায় ১ কোটি মার্কিন ডলার। সেদেশের জাতীয় সেচকাজ ব্যুরোর চিকো নদী পাম্প স্টেশন সেচ প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প ম্যানেজার রেইভেলিনো আপনগোল বলেন, প্রকল্পটি নির্মাণ করার আগে এখানকার প্রতি-হেক্টর জমিতে শুধু ২ মেট্রিক টন চাল উত্পাদন হত, তাও আবার যথেষ্ট বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু প্রকল্পটি সম্পন্ন করার পর প্রতি-হেক্টর জমি থেকে কমপক্ষে ৫ মেট্রিক টন ফসল কাটা যাবে।
প্রকল্পটি নির্মাতা কোম্পানি চীনের সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কো., লিমিটেডের প্রকল্প ম্যানেজার লি স্যুয়ানইয়ু বলেন, প্রকল্পের সবচেয়ে কঠিন বিষয় হলো দু’টো ১.৯২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সুড়ঙ্গ সুগম করা। ফিলিপিন্সের সেচকাজ ব্যুরো ডিজাইন করার সময় পাহাড় সুগম করার সংকট বিবেচনা করেনি, ফলে প্রকল্প নির্মাণের প্রক্রিয়ায় বিরাট সমস্যা ছিল।
তাই লি স্যুয়ানইয়ু এবং তাঁর সহকর্মীরা সমস্যা সমাধানের “চীনা পরিকল্পনা” দিয়ে সেচকাজ ব্যুরোর সুড়ঙ্গ নির্মাণের প্রক্রিয়ায় সার্বিক চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার বুঝিয়ে রাজি করেন। এটা মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রকল্প সময়মত সম্পন্ন করার জন্য ভিত্তি স্থাপন করেছে। পরে “চীনা পরিকল্পনা”টি ফিলিপিন্সের সেচকাজ ব্যুরোর “গোল্ডেন স্ট্যান্ডার্ডে” পরিণত হয়েছে।
লি স্যুয়ানইয়ু বলেন, ফিলিপিন্সের নির্মাণ প্রযুক্তি অনেক বছর নবায়ন করা হয়নি। তাদের ব্যবহৃত প্রযুক্তিগত স্ট্যান্ডার্ড গত শতাব্দীর ৮০ বা ৯০-এর দশকের। তাই বর্তমানের আরও জটিল নির্মাণ পরিবেশের সামনে তা উপযোগী নয়। কিন্তু বহু বছরের উন্নয়নের মাধ্যমে চীনের নির্মাণ প্রযুক্তি সবসময় নবায়ন করা হচ্ছে। সেজন্য চীনের নির্মাণ উপায় দেখার পর ফিলিপিন্সের অনেক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। চূড়ান্ত সংলাপের মাধ্যমে চীনের সম্পূর্ণ নির্মাণ পরিকল্পনা ফিলিপিন্সের সেচকাজ ব্যুরোর ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে তাদের অন্যতম নির্মাণ পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
চিকো নদীর সেচকাজ প্রকল্পের নির্মাণকাজ ২০১৮ সালে শুরু হওয়া থেকে ২০২২ সালে সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত চীনা প্রতিষ্ঠান স্থানীয় এলাকায় থাকার ৪ বছরে এতদঞ্চলের জন্য কিছু সংখ্যক প্রযুক্তিগত কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি পেরিফেরাল শিল্পের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেছে। নির্মাণ কাজ থেকে ব্যবহার পর্যন্ত প্রকল্পটি ৮ সহস্রাধিক স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং স্থানীয় অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
গত ২১ সেপ্টেম্বর চিকো নদীর আশপাশের গ্রামের শাখা চ্যানেলের পানি সরবরাহ পরীক্ষামূলকভাবে চালু ছিল। খবর পেয়ে অনেক গ্রামবাসী নিজেদের মাটিতে চ্যানেলটি দেখতে এসেছেন। এতদঞ্চলের কৃষিজমির সেচকাজ বৃষ্টির উপর নির্ভর করে অথবা ডিজেল পাম্প দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি পাম্প করার উপর নির্ভর করে। কৃষকদের জন্য খরচ খুবই বেশি। কিন্তু বর্তমানে সেচকাজ শাখা চ্যানেলটি সরাসরি কৃষিজমিতে পৌঁছায়। ফলে অনেক কৃষক আগামী ঋতুতে চাষ পরিকল্পনা শুরু করেছে। এমনকি কেউ কেউ ভুট্টার জমিকে ধানের জমিতে রূপান্তর করতে চান।
প্রকল্প ম্যানেজার লি স্যুয়ানইয়ু বলেন, চ্যানেলটা চালু হবার মুহূর্তটি ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে গর্বের সময়। নব্বই-এর দশকের তরুণ প্রকল্প ম্যানেজার হিসেবে প্রকল্পটি সময়মত হস্তান্তর করার জন্য তিনি ২ বছর স্বদেশে ফিরে যাননি। তাঁর বাগদত্তা তাঁর পথ চেয়ে বসে আছে। যত দ্রুত সম্ভব ফিরে গিয়ে বিয়ে করার অপেক্ষা করছেন। কিন্তু প্রকল্পের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য তাঁকে বার বার বিয়ের সময় পিছিয়ে দিতে হয়। চীনের ভালোবাসা দিবস মিস করেছেন, মধ্য-শরত্ উৎসবও মিস করেছেন, আবার জাতীয় দিবসে বাসায় ফিরে যেতে পারেননি তিনি। লি বলেন, বিদেশী নির্মাতাদের প্রকল্পের স্থানে অবস্থান করতে হয়। দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হয়।
লি স্যুয়ানইয়ু বলেন, প্রকল্পটির তাৎপর্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক ধরনের দায়িত্ববোধ আমাদের চালিয়ে নিচ্ছে। প্রকল্পটি ভালোভাবে শেষ করতে হবে এবং চীন-ফিলিপিন্স মৈত্রীর জন্য কিছু অবদান রাখতে হবে।
(প্রেমা/এনাম)