করোনা না যেতেই ডেঙ্গু-প্রকোপ: উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বাংলাদেশের মানুষ
2022-10-16 19:45:09


করোনা সংক্রমণ যখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে, বাংলাদেশের মানুষ যখন কিছুটা হলেও নিরুদ্বেগ হচ্ছিলেন, ঠিক তখনি ডেঙ্গু প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে। ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা দুটোই বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি। মানুষজন ফের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কখন নিজে কিংবা পরিবার-পরিজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন!

ডেঙ্গুর প্রকোপ কতটা বেড়েছে তা কিছু পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলেই আমরা সহজে বুঝতে পারবো।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া সবশেষ তথ্য অনুযায়ী গত শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ৭৩৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময়ে মারা গেছেন ৬ জন। এর আগের ২৪ ঘন্টায় ডেঙ্গুতে মারা যান রেকর্ড ৮ জন। আক্রান্ত হন ৭৬৫ জন।

চলতি বছর এ পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, ২৪ হাজার ৩২৬ জন। মারা গেছেন ৮৯ জন। আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে মারা যান ১০৫ জন আর আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন।

২০২০ সালে ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছিল  মাত্র ৭ জন। আক্রান্তও ছিল অনেক কম। সে ক্ষেত্রে পরের দু’বছর আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা অনেক বেশি। তবে, এ বছর আক্রান্ত ও মৃত্যু বিগত বছরগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ বিষয়টা চিন্তার ভাজ ফেলছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কপালে।

চলতি বছরের করোনার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে বিশেষ কিছু প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আগের বছরগুলোতে ডেঙ্গু প্রধানত রাজধানী ঢাকা এবং অন্য প্রধান কয়েকটি শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এ বছর তা এরই মধ্যে ৫০টা জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ধীরে ধীরে ঢাকাকেও ছাড়িয়ে যেতে বসেছে তা। ১৩ এপ্রিল মারা যাওয়া ৮ জনের মধ্যে ৫ জনই চট্টগ্রামের। ঢাকার ২ জন আর ১ জন বরিশালের।

চলতি বছর এ পর্যন্ত মৃত্যুর তালিকায় অবশ্য এখনো ঢাকা শীর্ষে। ৮৯ মৃত্যুর মধ্যে ঢাকায় ৫০ জন এবং ঢাকার বাইর ৩৯ জন। তবে অচিরেই সারাদেশে আক্রান্ত ও মৃত্যু ঢাকাকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এবারের আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সীরা বেশি মারা গেছেন ডেঙ্গুতে। আর পুরুষের তুলনায় নারী মৃত্যু হার প্রায় দ্বিগুণ। চলতি বছর ১২ অক্টোবর পর্যন্ত মারা যাওয়াদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা যেখানে ২৯ জন, সেখানে ৪৬ জন নারীর মৃতু হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ২৬ জন শিশু রয়েছে।

বর্তমানে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ২ হাজার ৮৮৯ জন ডেঙ্গু রোগী। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৯২ জন ঢাকায় আর ৮৯৭ জন দেশের অন্যত্র। ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি রোগী চট্টগ্রাম বিভাগে। আর জেলা হিসেবে কক্সবাজারে। একক হাসপাতালে মৃত্যুর দিক থেকেও কক্সবাজার সদর হাসপাতাল শীর্ষে রয়েছে।ু সেখানে মারা গেছেন ১৬ জন। আর ঢাকা মেডিকেল আর ও ঢাকা শিশু হাসপাতালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭ জন করে মারা গেছেন। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেলে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

রাজধানী ঢাকায়ও রয়েছে ডেঙ্গুর কিছু হটস্পট। হাসপাতালে রোগী ভর্তির তালিকা অনুযায়ী মিরপুর ও উত্তরা শীর্ষে। তারপর রয়েছে মুগদা। তৃতীয় সর্বোচ্চ রোগী এসেছে কেরাুনীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী ও ধানমন্ডি থেকে। এরপরে রয়েছে মোহাম্মদপুর, বাসাবো, খিলক্ষেত, খিলগাঁও, বাড্ডা, রামপুরা, কামরাঙ্গীরচর, ফার্মগেট, তেজগাঁও, মালিবাগ, আগারগাঁও, ভাটারা ও লালবাগ। ঢাকার বেশির ভাগ রোগী্ই আসছেন এ সব এলাকা থেকে।

কেন চলতি বছর করোনার প্রকোপ বাড়লো এবং বাড়ছে মৃত্যুও? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা প্রকোপের প্রধান একটি কারণ এবার ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে তিনটি সক্রিয় বাংলাদেশে- আগে যা হয়নি। আর বরাবরের মতোই ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নির্মূলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতাতো রয়েছেই।

আর মৃত্যু বাড়ার কারণ হিসেবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জনসাধারণের অসচেতনতা বা গা-না করাকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে আসতে দেরি করে ফেলেন। অবস্থা খারাপ হলে তারা হাসপাতালে আসেন। ততক্ষণে অনেকের অবস্থা জটিল হয়ে যায় এবং তাদের অনেককে আর বাঁচানো যায় না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ৬৪ শতাংশই হচ্ছে হাসপাতালে আসার ৩ দিনের মধ্যে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞরা আর সিটি করপোরেশনের নৈমিত্তিক মশক নিধন কর্মসূচির ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তারা এ জন্য আলাদা কোনো কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে তাদের এ দায়িত্ব দিতে পরামর্শ দিচ্ছেন।

আর এডিশ মশা নির্মূলে সাধারণ মানুষের সচেতন হবার পাশাপাশি জ্বর হলে বিলম্ব না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু সময়মতো হাসপাতালে গেলে ডেঙ্গুতে মৃত্যু অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।