অপরুপ ভূ-দৃশ্যের সুগন্ধী পাহাড়
2022-10-14 10:38:54

চায়না মিডিয়া গ্রুপ-সিএমজি এর বাংলা বিভাগে কর্মরত বাঙালী চাইনিজ প্রায় সবার সাথেই পরিচয় আছে আমার। এ বিভাগেই কাজ করেন চাইনিজ খোং চিয়া চিয়া। ওর বাংলা নাম অবশ্য প্রেমা খোং। প্রেমা কনফুসিয়াসের বংশধর। এজন্য নামের শেষে খোং পদবী লিখে। ওর সাথে পরিচয় বাংলাদেশ থেকে। করোনার আগে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের হয়ে অনেকদিন ঢাকায় কাজ করেছেন। তখন থেকে পরিচয়। এবার বেইজিং আসার পর থেকেই মাঝেমধ্যে উইচ্যাটে কথা হয় তার সঙ্গে। ২৪ সেপ্টেম্বর সকাল বেলা সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো ফ্রি আছি কিনা। হ্যা বলতেই ও অফার করলো তাহলে চলুন শিয়াংসান পাহাড় থেকে ঘুরে আসি। কাজ না থাকায় আমিও রাজি হয়ে গেলাম। আমি, প্রেমা এবং ওর ছেলে টাইগার। ছেলেটির বয়স এগার/বার বছর হবে। আমরা তিনজন রওনা হলাম শিয়াংসান পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। সাবওয়ে থেকে শেষ যে স্টেশনে নামতে হয় সেখান থেকে আবার আরেক ট্রেনে করে যেতে হয় শিয়াংসান পাহাড়ের কাছে। এই ট্রেনটি উপর দিয়ে চলে। খোলামেলা হওয়ায় চারদিকটা বেশ দেখা যায়। এটা মূলত বেইজিংয়ের উপকণ্ঠ এলাকা। সবুজ গাছগাছালিতে ভরপুর আরণ্যক অঞ্চল। দৃষ্টির শোভাবর্ধনকারী দৃশ্য। পথিমধ্যেই পড়ে প্রাচীন চীনা সম্রাটদের গ্রীস্মাকালীন অবকাশযাপন কেন্দ্র সামার প্যালেস ও বোটানিক্যাল গার্ডেন। সামার প্যালেসে ঘোরার ইচ্ছা দীর্ঘদিনের। কিন্তু আজকের উদ্দেশ্যে শিয়াংসান পাহাড়, তাই এসব জায়গায় নামা হল না। দুপুর বারোটা সাড়ে বারোটার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম শিয়াংসান পাহাড়ের পার্কে ঢোকার মূল গেটে। শিয়াংসান পাহাড়কে ঘিরেই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে পার্ক। প্রাচীনকালে সম্রাটদের নির্দেশেই এই পার্কটি গড়ে তোলা হয়। শিয়াংসান পাহাড়ের অর্থ সুগন্ধী পাহাড়। নামের সাথে এই পাহাড়ের বেশ মিল আছে। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই মন জুড়িয়ে গেল। ভেতরে নানা জাতের ফুলের শারদীয় সুবাস ছড়িয়ে আছে। গেট থেকে কয়েক পা যাওয়ার পরই হাতের বামে পরে ছিনজেং হল। হলটি অনেকটা নিষিদ্ধ নগরীর প্রাসাদের মত। চারচালা হল ঘরের দেয়াল পাথরের তৈরি। দেয়াল লাল আর গোল্ডেন কালারের ড্রাগনে সাজানো। হলটি চিংই বাগানের মধ্যে। এর অর্থ প্রশান্তীময় বাগান। হলঘরের পথটি সোনালি ইটের তৈরি। এর ভেতরে একটি রাজাসন বা সিংহাসন পাতা। বলার অপেক্ষা রাখে না এই সিংহাসনটিতে কে বসতেন।

প্রাচীন চীনা সম্রাটদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করে কালের সাক্ষী হিসেবে এখনও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সিংহাসনটি। এই হলটি তৈরি হয় ১৭৪৫ সালে। এখানে বেড়াতে আসলে সম্রাট এই হলে সভাসদের সঙ্গে মিলিত হতেন এবং রাজ কার্যের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতেন। মূল হলঘরের দক্ষিণও উত্তর দিকে আরও দুটি সাবসিডিয়ারি হলঘর রয়েছে। ওগুলোতে সম্রাটের মন্ত্রী ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা অবকাশ যাপন করতেন।

হলঘর বাগান থেকে বের হয়ে আমরা ছুটলাম সুগন্ধী পাহাড়ের চুড়ার দিকে। পাহাড়টির গায়ের উপর দিয়ে পাথুরে পথ। ঢালু পাহাড়ী পথ ক্রমেই উপরের দিকে উঠে গেছে। মাঝে মাঝে খাড়া সিঁড়ি। নিচ থেকে পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। আমরা হাঁটা শুরু করলাম। পুরো এলাকা পাইন, সাইপ্রাস, ম্যাপল, স্মোক ট্রিসহ নানা জাতের গাছাগাছালিতে ভরপুর। বনজঙ্গলের মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে উঠে গেছে পাহাড়ী পাথুরে পথ। কিছু জায়গায় সিঁড়িগুলো এতটাই খাড়া যে একটু অসতর্ক হলে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। কিছুক্ষণ ওঠার পরই হাঁপিয়ে উঠছি আমরা। খানিকটা জিড়িয়ে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু হয়। আমার মনে হল আমার চেয়ে সঙ্গী মায়ে-পুতের কষ্টটা একটু বেশি হচ্ছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ এরকম পাহাড়ে তো আর সবসময় ওঠা হয় না। করোনা বিধিনিষেধ থাকলেও বেড়াতে আসা দর্শণার্থী অনেক। সবার লক্ষ্য শিয়াংসান পাহাড়ের চূড়া। এত সুন্দর পাহাড়ী পার্ক। বেড়াতে না আসলে বুঝতে পারতাম না। মাঝে মঝে পথের দুধারে পাহাড়ের খাঁজে আরও কিছু হলঘর বা প্রাসাদের দেখা পেলাম। সবগুলোই পুরোনো। শত শত বছর ধরে এগুলো কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে তা সত্যিই এক বিস্ময়। এগুলোর কিছু কিছু এখন রেস্তোরাঁ, স্যুভেনিরের দোকান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আছে প্রাচীন টেম্পল। পাহাড় নদী সমুদ্র প্রায় সব প্রকৃতিপ্রেমী মানুষেরই পছন্দ। পাহাড়ে আসলে আমারও অসম্ভব ভাল লাগে। চারদিকের এতসুন্দর আরণ্যক প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে বিমোহিত হয়ে যাই। প্রায় দেড় দুই ঘণ্টা লাগলো চূড়ায় উঠতে। পাহাড় চূড়াটি খুব বেশি জায়গা নিয়ে নয়। আয়তন হয়তো বিঘা খানিক হবে। চূড়াটির নাম শিয়াংলু ফেং। এর অর্থ ধুপ জ্বালানো সুগন্ধী চূড়া। কারণ চূড়ায় রয়েছে দুটি বড় বড় পাথরখন্ড যা দেখতে অনেকটা জ্বলন্ত ধুপকাঠির মত। সমতল থেকে এর উচ্চতা ১৮২৭ ফুট। চূড়ার নামানুসারে এই পাহাড়ের নাম হয়েছে শিয়াংসান। এখানে আছে দুটি প্রাসাদ হলঘর। একটিতে নানা ধরনের স্যুভেনির, আইসক্রিম, ডিংকস রাখা। অন্যটি বন্ধ।

চূড়ার কিনারা দিয়ে দর্শণার্থীদের ভিড় অনেক বেশি। এখান থেকে পুরো বেইজিং শহর দেখা যায়। গগনবিদারী সুউচ্চ ভবনগুলো পাহাড়ের উপর থেকে কেমন তুচ্ছ দেখায়। পূর্বদিকে যতদুর দৃষ্টি যায় সাদা কালচে ভবন চোখে পড়ে। দুরে মনে হয় আকাশের সাদা শুভ্র মেঘমালা নেমে এসে মাটির সাথে মিশে গেছে। চূড়া থেকে নিচের দিকে তাকালে কিছুটা ভয় লাগে। সবুজ গাছপালায় আচ্ছাদিত ঢালু পাহাড়ের গা দেখতে অনেকটা পিরামিডের মত লাগে। এখান থেকে পড়লে রক্ষা নাই। লাশটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে পাহাড় চূড়ার কিনারা চারপাশে লোহা বা এ জাতীয় বস্তু দিয়ে ঘেরা। চূড়ায় ওঠা এবং নামার পথের পাশ দিয়েও তার দিয়ে ঘেরা। যাতে কেউ পড়লেও নিচে ছিটকে না পড়ে। উপরে কিছু সময় অবস্থান করে চারপাশের নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করলাম আমরা। এরপর আবার শুরু হল নিচে নামা। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা-নামার দুটি পথ। এবার আমরা অপর পথ অর্থাৎ চূড়া থেকে নিচে নামতে বাঁদিকের পথ দিয়ে নামা শুরু করলাম। প্রথম দিকে বেশ খাড়া ঢালু সিঁড়ি, সতর্কতার সাথে নামতে হল। প্রায় অর্ধেক পথের পর রাস্তা আর অতটা খাড়া নয়। বেশ ঢালু পথ। এ পথটির পাশেও জায়গায় জায়গায় হলঘর, লেক, ফুলের বাগান। শরতের শুভ্র সতেজ ছোঁয়ায় নয়নাভিরাম সাজে সেজে আছে চারদিকের প্রকৃতি। অপরুপ সৌন্দর্যে ভরা সুগন্ধী পাহাড়। একটা পাহাড়কে কেন্দ্র করে এরকম সুন্দর পার্ক গড়ে তোলা যায় তা সত্যিই না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর। মাঝেমাঝে প্রশ্ন জাগে এই পাহাড়ী অরণ্যে কি সাপ, বিচ্ছু বা অন্যান্য হিংস্র প্রাণী বাস করে না? করে কিনা জানিনা তবে কারো সাথে সাক্ষাৎ টাক্ষাৎ হয়নি। আমরা যখন সুগন্ধী পাহাড় থেকে নেমে আসলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সোনালী রোদের ঝিল্লিতে ভরে গেছে পুরো পাহাড়ী অরণ্য। পড়ন্ত বিকেলের শারদীয় সুমিষ্ট শীতল বাতাসের পরশ এসে লাগছে গায়ে। এরই মাঝে প্রশান্ত হৃদয়ে ক্লান্ত পায়ে সুগন্ধী পাহাড়কে পেছনে ফেলে স্টেশনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম আমরা।

মূলত শিয়াংসান পাহাড় বা সুগন্ধী পাহাড়ের পাদদেশে ৩৬৫ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে শিয়াংসান পার্ক। পুরো পার্ক ও পাহাড়ী এলাকাটি প্রাকৃতিক পাইন, সাইপ্রাস, ম্যাপল গাছ ও নানা ফুলে ফলে ভর্তি। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল এই পাহাড়ের সবকিছু মিলে অপরুপ ভূদৃশ্যে ভরপুর একটি পার্ক। পার্কটি প্রথম গড়ে তোলা হয় ১১৮৬ সালে চিন সাম্রাজ্যের আমলে। পরবর্তীতে ইউয়ান ও মিং সাম্রাজ্যের আমলে এর এলাকা বিস্তৃত করা হয়। ১৭৪৫ সালে ছিং সম্রাট ছিয়ানলং পার্কের ভেতরে অনেকগুলো প্রাসাদ, হলঘর, প্যাভিলিয়ন ও বাগান তৈরি করেন। তবে ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ এবং ১৯০০ সালে পশ্চিমাদের আট জাতির আক্রমণে সামার প্যালেসসহ পার্কটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পার্কে অবস্থিত প্রাসাদসমূহ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় আক্রমণকারীরা। পরবর্তীতে চায়না সরকার পার্ক এবং এর প্রাসাদসমূহ পুনরুজ্জীবিত করে। শিয়াংসান পার্ক এবং পাহাড় চূড়া দেশি বিদেশি পর্যটকদের কাছে বেড়ানোর জন্য অন্যতম একটি আকর্ষণীয় স্থান। পাহাড় চূড়ায় ওঠার জন্য কেবল কারের ব্যবস্থাও আছে।    


লেখক: ইমরুল কায়েস