অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটসের (ওএএস) সদ্য সমাপ্ত ৫২তম সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবে ফকল্যান্ড দ্বীপে আর্জেন্টিনার বৈধ অধিকার রক্ষাকে সমর্থন এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে মতভেদ দূর করার আহ্বান জানানো হয়।
ওএএস প্রথম বারের মতো এমন কথা বলছে- তা নয়। আসলে সংস্থাটিতে অনেক বার এমন প্রস্তাব পাস হয়েছে। সেসব প্রস্তাবে দ্বীপটিতে সার্বভৌমত্ব ফিরে পেতে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। আসল অবস্থা ও ন্যায়বিচারের দাবি অনুযায়ী, এমন প্রস্তাব পাস করা হয়। তাতে আমেরিকান দেশসমূহের অভিন্ন প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়, এবং ঔপনিবেশিকতার অবশিষ্ট সমস্যা নির্মূল করতে চায় আমেরিকান দেশগুলো।
ওএএসের মহাসচিব লুইস আলমারগো বলেছেন, এতদঞ্চলের দেশগুলো এ দ্বীপের সমস্যা নিয়ে একমত হয়ে জোর দিয়ে বলেছে, এ দ্বীপে যুক্তরাজ্যের অবশিষ্ট ঔপনিবেশিকতা অগ্রহণযোগ্য।
দ্বীপটি নিয়ে আমেরিকান দেশগুলোর প্রস্তাব যুক্তরাজ্য কী শুনেছে? আমরা ইতিহাসের দিকে একটু তাকিয়ে বুঝতে পারব যে দ্বীপটি ঔপনিবেশিকতার জীবন্ত ফসিল। ১৮১৬ সালে স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে আর্জেন্টিনা। পাশাপাশি, তারা এ দ্বীপের সার্বভৌমত্ব উত্তরাধিকার হিসেবে পায়। ১৮৩৩ সালে দক্ষিণ আমেরিকায় ঔপনিবেশিকতা সম্প্রসারণ করতে দ্বীপটিকে জোরপূর্বকে দখল করে যুক্তরাজ্য। ১৯৬৫ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়। তাতে দ্বীপটি নিয়ে সমস্যাকে উপনিবেশিকতার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং যুক্তরাজ্য ও আর্জেন্টিনাকে আলোচনার মাধ্যমে সার্বভৌমত্বের সমস্যা সমাধানের তাগিদ দেয়া হয়।
২০১৬ সালের জাতিসংঘের কমিশন অন দ্যা লিমিটস অব দ্যা কন্টিনেন্টাল শেলফ-এর রায় অনুযায়ী দ্বীপটি আর্জেন্টিনার জলসীমায় অবস্থিত। পাশাপাশি, জাতিসংঘ উপনিবেশকরণ বিশেষ কমিটিও বার বার আর্জেন্টিনার সঙ্গে আলোচনা করতে যুক্তরাজ্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তবে, যুক্তরাজ্য তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে এ সংকট কিছুতেই মিটছে না।
কেন যুক্তরাজ্য এ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে চায় না? কারণ যুক্তরাজ্য চায় দীর্ঘকালে এ দ্বীপের প্রচুর তেল ও গ্যাস সম্পদকে ভোগ-দখল করতে। সেসঙ্গে এ দ্বীপে নিয়মিত সামরিক মহড়া ও বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র মোতায়েন করার মাধ্যমে লাতিন আমেরিকায় তার সামরিক উপস্থিতির উপর জোর দিতে চায়। এতে যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলির উপনিবেশিক মানসিকতার প্রতিফলন দেখা যায়।
ইতিহাসবিদ স্টুয়ার্ট ল্যাককের গবেষণা অনুযায়ী, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাজ্য বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে। ইউরোপের মধ্যে বিদেশে যুক্তরাজ্যের আছে সবচেয়ে বেশি উপনিবেশ। যুক্তরাজ্য নিজেকে সভ্য দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করে, তবে তারা কখনও ভাবেনি যে ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণের অপরাধ মানব সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। রক্তাক্ত ঔপনিবেশিক ইতিহাস হল বিশ্ব মানবাধিকারের সবচেয়ে অন্ধকার সময়।
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সদ্য সমাপ্ত ৫১তম অধিবেশনে অংশগ্রহণকারীরা যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিকতার ঐতিহাসিক পাপ নিয়ে আত্ম-জিজ্ঞাসা করে এবং ভুলকে ঠিক করার দাবি জানিয়েছে।
ওএএস-সহ আমেরিকার অনেক সংস্থাও ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে আর্জেন্টিনার সাথে আলোচনায় বসতে যুক্তরাজ্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তবে, যুক্তরাজ্যের রাজনীতিবিদরা ‘ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটেছে’ বলে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এ দ্বীপকে চিরকালের জন্য দখল করতে চায় যুক্তরাজ্য। তবে, ইতিহাস শেষ হয়নি। জাতিসংঘ, ওএসসি ও চীনসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সমাজ আর্জেন্টিনার পক্ষে। শুধু আন্তর্জাতিক নৈতিকতার জন্য নয়, বরং ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বহুমুখী বিশ্ব গড়ে তুলতে তাদের এ অবস্থান। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গণতন্ত্রায়নের লক্ষ্যে ঔপনিবেশিকতার ইতি টানতে হবে। (শিশির/এনাম/রুবি)