৪ অক্টোবর জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ধাক্কা ৫ দিন পরেও সামলে উঠতে পারেনি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগ। গ্রিড বিপর্যয়ের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখনো চালু করা যায়নি। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কমকর্তারা বলছেন, সবগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র সচল করতে আরও অন্তত সপ্তাহ খানেক সময় লেগে যাবে।
এমন অবস্থায় ১৯ জুলাই থেকে চালু হওয়া ‘পরিকল্পিত লোডশেডিং’ আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষেরই প্রাণ জেরবার হওয়ার অবস্থা। রাজধানীতে তুলনামূলক কম হলেও অন্য শহর ও মফস্বলে দিনে ৬-৭ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। শিশু, শিক্ষার্থী, হাসপাতালে রোগীদের কষ্টের শেষ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে লোডশেডিংয়ের কারণে।
খোদ রাজধানীতে বিদ্যুৎ সমস্যা কতটা প্রকট রূপ নিয়েছে একটা পরিসংখ্যানেই তা পরিস্কার বোঝা যায়। ৮ অক্টোবর ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি-ডেসকোর আওতাধীন এলাকায় পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৯৫০ মেগাওয়াট। বিপরীতে সরবরাহ ছিল ৭০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ২৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে তাদের। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি.-ডিপিডিসির অবস্থাও একই রকম।
খোদ রাজধানীর অবস্থা যখন এই তখন অন্য শহর আর সারাদেশের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যায়। তারপরও বিষয়টা বুঝতে আমরা আরও কিছু পরিসংখ্যানে চোখ বোলাতে পারি।
৬ অক্টোবর দিনে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৬৫৪ মেগাওয়াট। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ছিল ৯ হাজার ৮২১ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল ১ হাজার ৬৮৯ মেগাওয়াট।
৭ অক্টোবর পিক আওয়ারে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। আর উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৫৭ মেগাওয়াট। লোডশেডিং করতে হয়েছে ১ হাজার ৬৯৮ মেগাওয়াট। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি থাকছে। এর ফলে পরিকল্পিত লোডশেডিং এখন খেয়ালখুশির লোডশেডিংয়ে পরিণত হয়েছে।
২০০৭ ও ২০১৪ সালে দেশে বড় বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছিল। এর পরে ২০১৭ সালের মে মাসে গ্রিড বিপর্যয়ে উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমের ৩২ জেলা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছিল কয়েক ঘন্টার জন্য। চলতি বছরের ৬ সেপ্টেম্বর গ্রিড বিপর্যয়ে রাজশাহী, খুলনা বরিশাল অঞ্চল দেড়ঘন্টা বিদ্যুৎবিহীন ছিল। সবশেষ ৪ অক্টোবর জাতীয় গ্রিডের ইস্টার্ন গ্রিডে বিপর্যয়ে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ বেশ কিছু এলাকা ৪ থেকে ৮ ঘণ্টার অধিক সময় বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে।
এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। অফিস, আদালত, বিমানবন্দর, হাসপাতাল, কল-কারখানা, রেলের টিকেট ক্রয়, বস্ত্রখাতের উৎপাদন ও ব্যাংকের এটিএম বুথ ও মোবাইল সেবায় বিঘ্ন ঘটে। বিদ্যুৎ না থাকায় চরম পানি সংকট দেখা দেয়।
৪ অক্টোবর এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার বিদ্যুৎ গ্রিডে বিপর্যয়ের পর দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। ওইদিন রাতেই পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ-পিজিসিবি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ৬ অক্টোবর বিদ্যুৎ বিভাগ গ্রিড বিপর্যয় তদন্তে আরেকটি কমিটি গঠন করে। কিন্তু কোনো কমিটি এখনো এ তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারেনি কিংবা সুনির্দিষ্ট করে ব্ল্যাকআউটের কোনো কারণ বলতে পারেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় মেশিন বা ইঞ্জিনিয়ারিং সিস্টেম। গোটা দেশজুড়ে এটি বিস্তৃত এবং একটার সঙ্গে আরেকটি যুক্ত। কাজেই কোনো একটি জায়গায় গোলোযোগ একটা বড় এলাকায় ব্ল্যাকআউটের কারণ হতে পারে। গ্রিড বিপর্যয়ের জন্য অনেক কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন:
১. চাহিদা ও যোগানের বড় ব্যবধান।
২. লোড ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক না থাকা।
৩. সঞ্চালন অবকাঠামোয় খামতি ও রক্ষণাবেক্ষণে না করা।
৪. পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন না হওয়া।
৫. ইকুইপমেন্ট ফেইলিওর।
জেনারেটর নষ্ট হওয়া, সাবস্টেশনের ব্রেকার নষ্ট হওয়া, শর্টসার্কিট এমনকি সঞ্চালন লাইনের তার ছিড়ে যাওয়ার কারণেও বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটতে পারে।
তবে বড় আকারের ব্ল্যাকআউটের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চাহিদা ও যোগানের বড় ব্যবধান, লোড ফ্রিকোয়েন্সি এবং সঞ্চালন কাঠামোয় দুর্বলতা দায়ী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যখন চাহিদার তুলনায় যোগান কম হয় তখন লোড বেড়ে যায় এবং লোড ফ্রিকোয়েন্সিতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে লোড ফ্রিকোয়েন্সিতে ভারসাম্য আনতে হয়। তা করা না গেলে একপর্যায়ে গ্রিডে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশে গত ৪ অক্টোবরের গ্রিড বিপর্যয়টি উৎপাদন বা সঞ্চালন পর্যায়ে ঘটে থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আগে থেকেই চাহিদা মতো উৎপাদন করতে পারছিলো না। সে কারণে লোড ফ্রিকোয়েন্সি কমে এ বিপর্যয় ঘটে থাকতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আর সঞ্চলন লাইনে সমস্যা তো রয়েছেই।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ৮০ শতাংশ অটোমেডেট হলেও সঞ্চালন ব্যবস্থা এখনো আধুনিকায়ন হয়নি। বিদ্যুৎপ্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিজেও এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
২০১৪ সালে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পর গঠিত তদন্ত কমিটি বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও সার্বিক কারিগরি উন্নয়নসহ ২০ দফা সুপারিশ পেশ করেছিল। কিন্তু গত ৮ বছরেও তার কোনো বাস্তবায়তি হয়নি। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ আমলে না নিলে ভবিষ্যতেও এমন আরও বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।