আমি একজন বিদেশী, তবে বহিরাগত না। কাজাখস্তানের শিক্ষার্থী মা ওয়েন সুয়ানের একথা অনেকের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের সি’আন শহরে করোনা মহামারি শুরু হয়। তখন মা ওয়েন সুয়ান একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। অনেক বিদেশী বন্ধু তার মতো অনেক বছর ধরে সি’আন শহরে বাস করেছেন। একে তারা তাদের দ্বিতীয় বাড়ি মনে করেন।
২০১৩ সালে চালু হয় ‘এক অঞ্চল এক পথ’ প্রস্তাব। তখন থেকে সি’আন পুরাতন রেশম পথের সূচনা বিন্দু হিসেবে বিদেশীদের স্বাগত জানাচ্ছে। উন্মুক্তকরণ, নবায়ন ও বসবাসের উপযোগী একটি শহরে পরিণত হয়েছে সি’আন। আরও বেশি বিদেশী এখানে এসেছে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে ও জীবনকে উপভোগ করতে।
মা ওয়েন সুয়ানের আসল নাম ইসমির দারোভ। তিনি এখন শ্যানসি ইউনিভার্সিটি অফ ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিনের স্নাতকোত্তরের ছাত্র। তার লেখাপড়ার মূল বিষয় হল আকুপাংচার এবং মাসাজ। এখন তিনি কাজাখস্তানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাচ্ছেন। তবে প্রতিদিন তিনি শ্যাসি প্রদেশে থাকা শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সবাই গবেষণার বিষয় ও নিজের জীবন নিয়ে কথা বলেন।
ইসমির দারোভ বলেন, তিনি ছোটবেলা থেকে চীনের সংস্কৃতি পছন্দ করেন। তার বাবা একটি চীনা ঐতিহ্যিক চিকিৎসার ক্লিনিক চালান। চীনা ঐতিহ্যিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে আরোগ্য লাভ করতে দেখে তিনি চীনা ঐতিহ্যিক চিকিৎসা শিখার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৩ সালে হাই স্কুল থেকে স্নাতক হবার পর তিনি চীনে এসেছেন। একই বছর চীন-ইউরোপ রেলপথ ধরে চাং আন নামক একটি ট্রেন যন্ত্রপাতি, বারাইট পাউডার এবং শিল্প লবণ নিয়ে সি’আন থেকে কাজাখস্তানের আলমাতি যাচ্ছিল। এটা চীন-ইউরোপের মধ্যে ‘এক অঞ্চল এক পথ’ সংশ্লিষ্ট শহরের প্রথম আন্তর্জাতিক কন্টেইনার ট্রেন।
সি’আন একটি প্রাচীন শহর । ২০০০ বছর আগে চাং ছিয়ান নামে একজন চীনা মানুষ এখান থেকে পশ্চিমা দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। থাং রাজবংশ আমলে রাজধানী সি’আনে বাস করতেন হাজার হাজার বিদেশী। তারা ছিলেন রেশম পথ দিয়ে চীনে আসা উটের কাফেলার ব্যবসায়ী।
বর্তমানে চীন-ইউরোপ রেলপথের ছাং আন ট্রেনের যাত্রার সংখ্যা প্রতিবছর ৪৬ থেকে বেড়ে ৩৮৪১টিতে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মাল-পরিবহন রেলপথের সংখ্যা ১৬টিতে উন্নীত হয়েছে। সি’আন শহরে চালু হয়েছে ৯৭টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট এবং বিশ্বের ৩৭টি দেশে এখান থেকে যাওয়া যায়।
বৃটিশ নাগরিক রবিন গিলব্যাঙ্ক ২০০৮ সালে নর্থওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী ভাষা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। শুরুতে তিনি সি’আন সম্পর্কে ছিন রাজবংশীয় আমলের সৈন্য ও ঘোড়ার টেরাকোটা ছাড়া আর কিছুই জানতেন না। তবে, এখন তিনি সি’আন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন। তিনি নর্থওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী ভাষা বিভাগের প্রধান হু চং ফেংয়ের সঙ্গে শ্যাসি প্রদেশের লেখকদের ৩০টিরও বেশি শিল্পকর্মকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এবং অনুবাদের মাধ্যমে বিদেশে সি’আনকে জানাতে পেরেছেন।
কঙ্গো (ব্রাজাভিল) থেকে আসা ছেলে ইং ইউং খুব ভাল চীনা ভাষা বলতে পারেন। তিনি বলেছেন, তিনি চীন ও আফ্রিকার মধ্যে একটি যোগাযোগের সেতু নির্মাণ করতে চান এবং এ সেতুর মাধ্যমে আফ্রিকান উপাদান চীনে নিয়ে আসা এবং আসল চীনকে আফ্রিকার কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ায় কাজ করবেন।
গত বছর তিনি ছাং আন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং সি আনে একটি মিডিয়া কোম্পানি স্থাপন করেছেন। তিনিও প্রথম জন যে সি আন অবাধ বাণিজ্য এলাকায় প্রথম নিজস্ব ব্যবসায়ীর ভিসা অর্জন করেন।
২০১৬ সালে আন্তঃদেশীয় অঞ্চল ও ‘এক অঞ্চল এক পথ’ সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার নতুন পদ্ধতির খুঁজে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্যানসি অবাধ বাণিজ্য এলাকা। শ্রেষ্ঠ বিদেশী শ্যানসি প্রদেশে নিজের ব্যবস্থা দাঁড় করাতে সমর্থন করা হল অবাধ বাণিজ্য এলাকার গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি।
যারা এখানে ব্যবসা শুরু করতে চান তাদেরকে পূর্ণ-প্রক্রিয়া উদ্যোক্তা পরিষেবা এবং এ সম্পর্কিত ভর্তুকি প্রদান করে অবাধ বাণিজ্য এলাকা। বর্তামানে তাদের সাহায্যে ২৮ জন বিদেশী ব্যবসার লাইসেন্স পেয়েছেন।
কানাডিয়ান জন কারমাইকেল সিলিকন ভ্যালিতে কাজ করতেন। তিনি সফটওয়্যার আর্কিটেকচার ডিজাইন এবং ডেটা প্রসেসিং মেকানিজম বিশেষজ্ঞ। ২০১৮ সালে তিনি সি’আন আওকা কোম্পানির ক্লাউড ডেটা টেকনোলজি কোং লিমিটেডের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি মনে করেন, সি’আন শহরের অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়ন নবায়নের উপর নির্ভর করে। দশ বছরের মধ্যে সি’আনে জাতীয় উচ্চ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কোম্পানির সংখ্যা ৭ হাজার ছাড়িয়েছে এবং আগামী ৫ বছরে এ সংখ্যা বেড়ে ১২ হাজারে দাঁড়াবে।
ভিটোমিরা লোনকার সুপরিচিত ক্রোয়েশিয়ান অভিনেত্রী এবং প্রযোজক। যিনি ৪০টিরও বেশি নাট্য পরিবেশনা করেছেন। ২০১৬ সালে অবসর নেওয়ার পর, তিনি এবং তার স্বামী সি’আনে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এ দম্পতি জানিয়েছেন, সি’আন একটি বহু-সংস্কৃতি কেন্দ্র। পুরাতন ও আধুনিক, পশ্চিম ও পূর্বের সংস্কৃতি এখানে মিশ্রিত হয়েছে। তারা বাসে করে পুরাতন নগরে বেড়াতে যান, স্থানীয় খাবার খান এবং লোক নাটক উপভোগ করেন। চীনের ১৩টি রাজবংশ আমলের রাজধানী হিসেবে সি আনে রয়েছে ১৫৯টি যাদুঘর, ৪টি জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট পার্ক।
ভিটোমিরা লোনকারের মতো অনেক বিদেশী আরামদায়ক ও সুবিধাজনক পরিবেশের কারণে সি’আনে বাস করতে আসেন। বর্তমানে ১০ হাজারের বেশি বিদেশী ১.৩ কোটি স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সুন্দর এ শহরে লেখাপড়া, কাজ ও জীবনযাপন করছেন। (শিশির/এনাম/রুবি)