১ অক্টোবর জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চীনে উদযাপিত হয়েছে দেশটির ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বিভিন্ন দেশে চীনের দূতাবাস ও চীনা কমিউনিটির মানুষজনও নানা আয়োজনে উদযাপন করে জাতীয় দিবস। এ সব অনুষ্ঠানে শামিল হন সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের কর্তাব্যক্তি ও বিভিন্ন মহলের চীন অনুরাগী বন্ধুরা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ বিশ্বনেতারা চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংসহ চীনা নেতাদের অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন এ উপলক্ষে।
বাংলাদেশ এবার চীনের জাতীয় দিবস ও ৭৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন একটু আগেভাগেই হয়েছে। এ উপলক্ষে ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকায় জাঁকজমকপূর্ণ উদযাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চীনা দূতাবাস। সন্ধ্যায় মূল অনুষ্ঠানের আগে চায়না-বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজেস কো-অপারেশন ফোরামের সম্মেলন এবং কালারফুল ইউননান নামে বর্ণাঢ্য প্রদর্শনীর আয়োজন ছিল।
পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্রে এ সব অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদসহ বাংলাদেশ ও চীনের সংশ্লিষ্ট মহলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, ব্যবসায়ী নেতা, সাংবাদিক, গবেষক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং তিনটি অনুষ্ঠানেই উপস্থিত থেকে অতিথিদের স্বাগত জানান এবং গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন।
ওই সব অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও চীনের ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা স্মরণ করেন দু’দেশের কর্মকর্তারা। দুদেশের এ ঐতিহ্যিক সম্পর্ক আগামী দিনগুলোতে আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।
আগেই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হওয়ায় ১ অক্টোবর ঢাকায় বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান ছিল না চীনের জাতীয় দিবসে। তবে এ’দিন বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। ক্রোড়পত্রে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংকে পাঠানো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিনন্দনবার্তার চুম্বক অংশ উদ্ধৃত করা হয়েছে। এ ছাড়া চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে- যেখানে বাংলাদেশ ও চীনের ঐতিহ্যিক বন্ধুত্ব এবং উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে ভবিষ্যতের যৌথ অভিযাত্রার আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়েছে।
ক্রোড়পত্রে রাষ্ট্রপতি হামিদের অভিনন্দন বার্তা থেকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও চীন পারস্পরিক শ্রদ্ধা, যৌথ মূল্যবোধ, মূল জাতীয় লক্ষ্য সমূহে অভিন্নতা এবং পারস্পরিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে সহযোগিতার মূলনীতিগুলোর ভিত্তিতে চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উপভোগ করে। আমাদের সম্পর্কগুলো বৈচিত্র্যময় ক্ষেত্রসমূহে বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবিশ্বাস্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি আত্মবিশ্বাসী যে, আমাদের দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্বের বন্ধনগুলো আগামী দিনগুলোতে আরও মজবুত ও গভীর হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিনন্দন বার্তায় বলেন, বাংলাদেশ ও চীন চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উপভোগ করে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মূল্যবান অংশীদার। আমাদের সম্পর্ক বিশেষ করে গত এক দশকে একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
২০১৬ সালে সি চিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময় আমরা নিজেদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কৌগলগত অংশীদারত্বে সম্প্রসারিত করার বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছিলাম। কৌশলগত অংশীদারত্বের সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে আরও সহযোগিতার ক্ষেত্র উন্মোচনের এটাই সেরা সময়।
২০১৯ সালে নিজের চীন সফর ও সেখানে প্রেসিডেন্ট সি’র সঙ্গে বৈঠকের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ ও চীন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের দুই দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক সামনের দিনগুলোতে আরও গভীর হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
ক্রোড়পত্রে ‘নতুন যুগে যৌথ অভিযানে বাংলাদেশের সহযাত্রী চীন'- শীর্ষক নিবন্ধে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং তিনটি প্রধান বিষয়কে তুলে ধরেছেন।
প্রথমত: ২০৪৯ সালের মধ্যে একটি আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশ হওয়ার পরবর্তী শতবার্ষিক লক্ষ্য নিয়ে চীনের এগিয়ে যাওয়া।
লি জিমিং লিখেছেন, সিপিসি ২০১২ সালে ১৮তম জাতীয় কংগ্রেসে মিলিত হবার পর থেকে সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিংকে মূলে রেখে দলটির নেতৃত্ব চীনা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সমাজতন্ত্রের পথে চীন একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। গত এক দশকে চীন দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে দ্রুত অর্থনৈথিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ৬.৬ শতাংশ হারে দেশের জিডিপির বার্ষিক গড়প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
চীন নিরঙ্কুশ দারিদ্রের একটি ঐতিহাসিক সমাধান নিয়ে এসেছে এবং এভাবে সর্বক্ষেত্রে একটি পরিমিত সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন রাষ্ট্রদূত।
দ্বিতীয়ত: বিশ্বের প্রতি নিজ দায়িত্বের বিষয়ে চীন সচেতন ও অঙ্গীকারাবদ্ধ।
রাষ্ট্রদূত লি জিমিং লিখেছেন, চীন বিশ্বশান্তির নির্মাতা, বিশ্ব উন্নয়নে অবদানকারী এবং বিশ্বব্যবস্থার রক্ষাকারী হওয়ার অঙ্গীকার করে। তবে চীন যে কোনো স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতা, গোষ্ঠী সংঘর্ষ কিংবা একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে। বৈশ্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা জন্য প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-বিআরআই এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চীনের প্রেসিডেন্টের গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ-জিএসআই প্রস্তাবনা এবং বাস্তবায়ন উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন লি জিমিং।
বাংলাদেশ ও চীনকে বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশি ও এবং অপরিহার্য কৌশলগত অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত লি জিমিং লিখেছেন, নতুন যুগের জন্য চীনা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতন্ত্রের চিন্তাধারায় প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের নির্দেশনায়, চীন বাংলাদেশের সাথে যৌথ উন্নয়নে নিবেদিত রয়েছে।
‘মহান জাতীয় পুনরুজ্জীবনে চীনা স্বপ্ন এবং ‘সোনার বাংলা’ স্বপ্নের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে- প্রেসিডেন্ট সির এ বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, তার গভীর বিশ্বাস বাংলাদেশ ও চীনের নেতৃবৃন্দের যোগ্য নেতৃত্বে দু’দেশের বন্ধুত্বের বন্ধন চিরকাল ঘনিষ্ঠ ও দৃঢ় থাকবে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।