চীনা চলচ্চিত্রের বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় অনুবাদের ভূমিকা
2022-09-29 19:01:35

প্রতিবছর ৩০ সেপ্টেম্বর পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস’। ২০১৭ সালের ২৪ মে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তঃসংযোগ এবং শান্তি, বোঝাপড়া এবং উন্নয়ন প্রচারে পেশাদার অনুবাদের ভূমিকার নিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। তাতে ৩০ সেপ্টেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

 

১৮৯৬ সালে চীনে চলচ্চিত্র প্রবর্তনের পর থেকে চলচ্চিত্র অনুবাদ ভাষ্যকার, সাব-টাইটেল অনুবাদ, ডাবিং অনুবাদ ইত্যাদি উপায়ে চীনে প্রবেশ করছে বিদেশি চলচ্চিত্র। তা ছাড়া, বিশ্বে চীনা মুভির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতেও এটি একটি বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকের সাংস্কৃতিক বিনিময়, জনসাধারণের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে সমৃদ্ধ করে তোলা এবং চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশকে বেগবান করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র অনুবাদ বিশাল ভূমিকা পালন করেছে।

 

চীনা চলচ্চিত্রের বিদেশী ভাষায় অনুবাদের একটি দীর্ঘ ইতিহাস এবং সমৃদ্ধ ক্রিয়াকলাপ রয়েছে, যা প্রায় চীনা চলচ্চিত্র বিকাশের পুরো প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত এবং এটি চীনা চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিংশ শতাব্দীর ২০’র দশকের গোঁড়ার দিকে, যখন জাতীয় চলচ্চিত্র শিল্প তার শৈশবকালে ছিল, তখন চীনা চলচ্চিত্র কোম্পানিগুলো তাদের চলচ্চিত্রে চীনা এবং ইংরেজি সাব-টাইটেল যুক্ত করতে শুরু করে। অনুবাদের সাহায্যে আন্তর্জাতিক বাজার উন্মুক্ত করতে এবং চীনা সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার আশা পোষণ করে। অনুবাদের সাহায্যে চীনা চলচ্চিত্রগুলো কেবল চীনে বসবাসকারী আন্তর্জাতিক দর্শকদের আকর্ষণ করেনি, বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকার বাজারে পৌঁছেছে।

 

প্রারম্ভিক চীনা চলচ্চিত্রের বিদেশী অনুবাদ একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, কিন্তু একটি শৈল্পিক ঐকমত্য ছিল। ১৯৩১ সালের আগে প্রকাশিত বিদ্যমান চীনা চলচ্চিত্রের চীনা ও ইংরেজি সাব-টাইটেল রয়েছে। যখন এসব চলচ্চিত্র চীনে প্রদর্শিত হয়, তখন চীনা ও ইংরেজি দ্বিভাষিক সাব-টাইটেল সহ সম্প্রচারিত হত। চীনা শ্রোতারা যখন চলচ্চিত্র উপভোগ করতেন, তখন তারা বিশ্বের সাথে সংলাপের আধুনিক অভিজ্ঞতা পান।

 

জাপান-বিরোধী যুদ্ধের সময় চীনা চলচ্চিত্র অনুবাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে চীনা জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে তুলে ধরেছিল এবং চীনা জনগণের জাপান-বিরোধী যুদ্ধের জন্য একটি অনুকূল আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করেছিল। সাউন্ড ফিল্ম প্রযুক্তির আবির্ভাব এবং পরিপক্বতার সাথে সাথে চীনা চলচ্চিত্রের বিদেশী অনুবাদও ডাবিং অনুবাদের চেষ্টা শুরু করে। ১৯৪৭ সালে, ‘দ্যা বারবার টাটেসা ওয়াইফ’ চলচ্চিত্রটি শাংহাই শহরে মুক্তি পাওয়ার পর হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। এটি ব্রিটিশ এবং আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আকৃষ্ট করেছিল।

 

পরিচালক হুয়াং চুও লিন নিজ উদ্যোগে অনুবাদ পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। চীনা সংলাপ ইংরেজিতে অনুবাদ করতে ২০ জনেরও বেশি ইংরেজি ডাবিং অভিনেতাকে বেছে নিয়েছেন, যাদের ইংরেজি দক্ষতা এবং নির্দিষ্ট মঞ্চের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

 

ফিল্মটি ইংরেজিতে অনুবাদ করার পর এটি বিদেশে ‘অত্যন্ত ভাল পারফর্মেন্স’ অর্জন করেছে এবং এটি অন্যান্য কোম্পানিগুলোকে ভয়েস অনুবাদসহ চীনা চলচ্চিত্র অনুবাদ করার চেষ্টা করতে অনুপ্রাণিত করেছে।

 

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর চীনা চলচ্চিত্রের বিদেশী অনুবাদ চীনের সাংস্কৃতিক কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে। জেনেভা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই নিজ উদ্যোগে অপেরা ফিল্ম ‘লিয়াং শানবো এবং চু ইং থাই’কে চীনের ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ হিসেবে অনুবাদ করেন, যার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতি প্রদর্শন করা হয়। চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন অনুবাদের সাহায্যে চীনা চলচ্চিত্রগুলো বিদেশী দর্শকদের চীনকে জানার একটি গুরুত্বপূর্ণ জানালা হয়ে উঠেছে।

 

বিংশ শতাব্দীর ৬০ বা ৭০-এর দশকে হংকংয়ের ফিল্মগুলো কুং ফু ফিল্মের ক্ষেত্রে একটি অনন্য শৈলী তৈরি করেছিল এবং ডাবিং অনুবাদের সাহায্যে হংকংয়ের কুং ফু ফিল্মগুলো বিশ্বের কাছে চলে যায়। ১৯৭৩ সালে, ‘কিং বক্সার’-এর ইংরেজি ডাব করা সংস্করণটি যুক্তরাষ্ট্রে প্রদর্শিত হয়েছিল এবং বক্স অফিসে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছে মুভিটি। চলচ্চিত্রটির ইংরেজি ডাবিং আরও কুং ফু চলচ্চিত্রের ভিত্তি স্থাপন করে, যা বিদেশে বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত হবে। হংকং-এ কর্মরত বিদেশীরা হাজার হাজার হংকং সিনেমা ইংরেজিতে ডাব করেছে, ব্রুস লি-এর মতো মার্শাল আর্ট তারকাদের ইংরেজি ভয়েস বিকল্প হয়ে উঠেছে। যদিও বর্তমান মানদণ্ড অনুসারে, এসব চলচ্চিত্রের ইংরেজি ডাবিং তুলনামূলকভাবে মোটামুটি, মুখের আকার কখনও কখনও সঠিক না, এবং লোকদের হাসাতে পারে, তবে এটি অনস্বীকার্য যে কুংফু চলচ্চিত্রগুলো ইংরেজিতে ডাব করা না হলে এটি সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তো না।

 

সংস্কার এবং উন্মুক্তকরণের পর চীনা চলচ্চিত্রগুলো আরও শক্তিশালী গতিতে বিশ্বে প্রবেশ করেছে এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মহলের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতি এবং দৃষ্টি রাখা অনুবাদের শক্তি থেকে অবিচ্ছেদ্য। যেমন, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রবাসী চীনা অনুবাদক লি ডিং ‘রেড সোর্ঘাম’ নামে মুভি’র জন্য মনোযোগ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন, সিনোলজিস্ট চিয়া পেইলিন ‘ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন’ নামে মুভি’র ইংরেজি সাব-টাইটেল নিয়ে গবেষণা করেন। চলচ্চিত্র অনুবাদ বিশ্বের কাছে চাইনিজ চলচ্চিত্র পৌঁছানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে ।

 

একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করে বিশ্ব চলচ্চিত্র শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ফিল্মের সাব-টাইটেল অনুবাদ এবং ডাবিংকে আরও সুবিধাজনক করে তোলে এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তি চলচ্চিত্র অনুবাদ এবং প্রচারকে আগের চেয়ে সহজ করে তোলে। গভীর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে চীনের চলচ্চিত্র শিল্প উন্নতি লাভ করছে। ফিল্ম আউটপুট, প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা এবং বক্স অফিস আয়ের দিক থেকে চীনা চলচ্চিত্র বিশ্বের শীর্ষে স্থান পেলেও চীনা চলচ্চিত্রের বৈদেশিক প্রচার, প্রভাব এবং বক্স অফিস আয় এখনও হলিউডের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

 

চীনা চলচ্চিত্র চীনা সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহক। ২০১২ সালের পর ‘চীন-আফ্রিকা চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সহযোগিতা প্রকল্প’, ‘সিল্ক রোড চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সেতু প্রকল্প’, ‘সমসাময়িক শিল্পকর্মের অনুবাদ প্রকল্প’ এবং ‘চীনা চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অনুবাদ কর্মশালা’সহ জাতীয় পর্যায়ের অনুবাদ প্রকল্পের সাহায্যে চীনা চলচ্চিত্রের বিদেশী ভাষায় অনুবাদের কাজ এবং অনুবাদ প্রতিভার নির্মাণ কাজ একটি নতুন স্তরে পৌঁছেছে। এছাড়া, বিশ্বব্যাপী ভক্তরাও চীনা চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন শিল্পকর্মের অনুবাদে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠেছে, তাদের প্রিয় চীনা চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনকে একাধিক ভাষায় সাব-টাইটেল দিয়ে বিশ্ব দর্শকদের কাছে নিয়ে গেছে।

 

চীন চলচ্চিত্রের শক্তিশালী দেশে পরিণত হওয়ার সাথে সাথে চীনা চলচ্চিত্রের বিদেশী অনুবাদ আরও বেশি আন্তর্জাতিক দর্শকদের চীনা চলচ্চিত্র বুঝতে সাহায্য করবে, চীনা সংস্কৃতির আকর্ষণ ও আবেদন বাড়াবে এবং চীনা ও বিদেশী সংস্কৃতির বিনিময় ও পারস্পরিক শিক্ষাকে বেগবান করবে বলে মনে করা হয়।

 

এ ব্যাপারে একটা উদাহরণ দিতে চাই: ‘ক্রেজি অ্যালিয়েন’ নামে চীনের একটি মুভি অনুবাদের সময় চীনের একটি পেশাদার অনুবাদ দলের সদস্যরা এর মধ্যে ‘বাইচিউ’ শব্দটি নিয়ে একমত হতে পারছিলেন না। কেউ মনে করেন, সরাসরিভাবে ‘বাইচিউ’ শব্দের চীনা ভাষার উচ্চারণে অনুবাদ করা যায়-যেমন, ‘তফু’ শব্দ, এতে আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে। কেউ আবার মনে করেন, বিদেশি দর্শকদের বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে একে অনুবাদ করতে হবে। অনেক চিন্তাভাবনার পর অনুবাদকরা চীনা ভাষায় ‘বাইচিউ’ শব্দকে ‘মদে’ অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নেন। তারা মনে করেন, সাহিত্য শিল্পকর্মের অনুবাদের চেয়ে চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন নাটকের সাব-টাইটেলের অনুবাদ দর্শকদের সহজেই বোঝানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

 

বইয়ের অনুবাদে চীনা এবং ইংরেজি শব্দ বেশি বা কম থাকলে খুব সমস্যা নয়, তবে ফিল্ম এবং টেলিভিশন নাটকের অনুবাদ ভিন্ন রকম। সাব-টাইটেলগুলো চোখ দিয়ে পড়তে হয় এবং চোখের গতি সাধারণত কানের গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না, তাই সাব-টাইটেলগুলোকে সহজ করতে হবে, তা না হলে দর্শকদের বোঝার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

 

চলচ্চিত্র বা টিভি নাটকের অনুবাদের ক্ষেত্রে চ্যানেল এবং শ্রোতাদের সম্পূর্ণরূপে বিবেচনা করা উচিত। দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন নাটকের অনুবাদের প্রয়োজন।

 

লিলি/এনাম/রুবি