মহাপ্রাচীরের কোলে গ্রামীণ শিক্ষকদের প্রচেষ্টা
2022-09-26 10:52:08

 

মহাপ্রাচীর চীনের সুবিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলোর অন্যতম। বিদেশি পর্যটকদের জন্য এটি চীনের গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যটনস্থান। যারা মহাপ্রাচীরে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ পান, তাদের যাওয়ার আগ্রহও অনেক বেশি। মহাপ্রাচীরের কোলে অনেক ছোট ছোট গ্রাম রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই এসব গ্রাম দূরবর্তী এলাকায় অবস্থিত এবং যাতায়াতব্যবস্থাও সুবিধাজনক নয়। এখানকার অনেক গ্রামীণ বাচ্চা রয়েছে। তাদের শিক্ষা দিতে বিভিন্ন প্রজন্মের শিক্ষকরা দূরবর্তী স্থান থেকে আসেন। আজকের আসরে চীনের হ্যপেই প্রদেশের মহাপ্রাচীরের কাছে একটি ছোট গ্রামের শিক্ষক-দম্পতির গল্প তুলে ধরবো।

 

ভোরবেলার কুয়াশা আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গেছে। পাহাড়াঞ্চলের উপর নির্মিত মহাপ্রাচীরও দূর থেকে যেন কাছে চলে এসেছে। হ্যপেই প্রদেশের থাংশান শহরের ছিয়ানসি জেলায় লিচিয়াইয়ু গ্রামের শিক্ষক ইয়াং চিন লু এবং তাঁর স্ত্রী শিক্ষিকা চাং হাই ইয়ান তাঁদের ব্যস্ত দিন শুরু করেছেন। বহু বছর ধরে এ গ্রামের স্কুলে বাইরে থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকারা আসছেন ও চলেও যাচ্ছেন, কেবল তাঁরা দু’জন দীর্ঘকাল এখানে শিক্ষকতার কাজ করে যাচ্ছেন। স্কুলই তাদের বাড়ি। দু’জন পরস্পরের হাত ধরে সুন্দর গ্রামীণ জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন।

 

নিজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে শিক্ষক চাং হাই ইয়ান বলেন, ২০০৩ সালে তিনি হ্যপেই ক্রীড়া একাডেমি থেকে স্নাতক হন এবং তাঁর জন্মস্থান থাংশান শহরের ছিয়ানসি জেলার একটি মাধ্যমিক স্কুলে ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন। সেখানে তিনি স্বামী ইয়াং চিন লু’র সাথে পরিচিত হন এবং তখন দু’জনের বয়স প্রায় সমান ছিল। অনেক কথা নিয়ে আলোচনা করতেন তারা। একসময় দু’জন প্রেমে পড়েন ও বিয়ে করেন।  পরে তাদের একটি বাচ্চাও হয়।

 

২০০৬ সালে ছিয়ানসি জেলার অনেক স্কুল একত্র করা হয় এবং ইয়াং চিন লু দূরবর্তী এলাকার লিচিয়াইয়ু প্রাথমিক স্কুলে নিয়োগ পান। তখন দু’জনের পরস্পরের সাথে দেখা করা খুবই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, এ গ্রাম ছিয়ানসি জেলার সবচেয়ে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। জেলার সাথে দূরত্ব ১০ কিলোমিটার হলেও, পাহাড়াঞ্চলের পথ অতিক্রম করতে অনেক সময় হাঁটতে হয়। ফলে শিক্ষক ইয়াংকে তখন স্কুলে থাকতে হয়  এবং স্ত্রী চাংকে স্কুলের কাজ করার সাথে সাথে বাচ্চারও যত্ন নিতে হয়। জীবনের এই কষ্ট দু’জনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

 

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষক ইয়াং চিন লু প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষা বিভাগের পরিচালক হন এবং তখন স্কুলের প্রেসিডেন্ট শিক্ষক চাংকে স্কুলে নিয়োগের পরামর্শ দেন। এভাবে তাঁরা পরস্পরের সাথে আবার মিলিত হন। স্ত্রী চাং বলেন, যদিও স্কুলের পরিবেশ ও অবকাঠামো জেলার মাধ্যমিক স্কুলের চেয়ে দুর্বল, তবে পরিবারের সবাই একসাথে থাকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

 

শিক্ষক ইয়াং গ্রামীণ স্কুলের অবস্থা তুলে ধরে বলেন, লিচিয়াইয়ু প্রাথমিক স্কুল গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকে নির্মিত হয়। এটি স্থানীয় গ্রামের একটি পুরনো স্কুল। যদিও বহুবারের মতো মেরামত করা হয়েছে, তবে স্কুলের ক্লাসরুমসহ বিভিন্ন অবকাঠামোব্যবস্থা দুর্বল।

 

২০১৫ সালে স্কুল নতুন করে সাজানো হয়। এর আগে ক্লাসরুম ও খেলার মাঠ ছিল অনেক পুরনো। শীতকালে রুমে কোনো হিটিং ব্যবস্থা ছিল না, শুধু কয়লা ও কাঠ জ্বালিয়ে ক্লাসরুম একটু গরম রাখার চেষ্টা করা হতো।

 

বহু বছর আগে যখন কোনো শিক্ষক বাইরে থেকে আসতেন, তখন তাদের কেউ কেউ এক বছর, এমনকি কেউ কেউ এক মাস থেকেই চলে যেতেন। ফলে লিচিয়াইয়ু প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকের অভাব লেগেই থাকো। বর্তমানে স্কুলের প্রেসিডেন্টসহ মোট ৮ জন শিক্ষক রয়েছেন। তাদের ওপর কাজের চাপ অনেক বেশি। শিক্ষিকা চাং হাই ইয়ান তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাসের প্রধান শিক্ষক।  তিনি চীনা ভাষা, গণিত, ইংরেজি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি স্কুলের গ্রন্থাগার দেখাশোনার দায়িত্বও পালন করেন।

 

নিজেদের জীবন সম্পর্কে শিক্ষক ইয়াং বলেন, ‘আমাদের বাচ্চা মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির পর,আমরা স্কুলের ২০ কিলোমিটার দূরে জেলায় বসবাস করে আসছি। তবে, স্কুলের শিক্ষার্থীদের দেখাশোনা করার জন্য, প্রতি সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ডিম, শাকসবজি ও খাদ্যশস্য নিয়ে স্কুলে থাকি। শুধু সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়িতে ফিরে যাই।’

 

স্কুলের আরেকজন শিক্ষক থিয়ান কুই ইউয়ান বলেন, তাদের প্রাথমিক স্কুলের কাছে দুটি গ্রাম আছে। সেখানকার বাচ্চারা দুপুর বেলায় স্কুল থেকে বাসায় ফিরে গেলেও, কেউ তাদের দেখাশোনা করার নেই। ফলে শিক্ষক ইয়াং ও শিক্ষিকা চাং সবসময় কয়েকজন বাচ্চার জন্য লঞ্চ রেডি করেন এবং তাদের বাসায় পাঠিয়ে দেন। যদি কোনো বাচ্চার আর্থিক অবস্থা দুর্বল থাকে, তারা সেসব বাচ্চার বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেন।

 

শিক্ষিকা চাং বলেন, এ স্কুলের বাচ্চারা অনেক লাভলি। তাদের সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ছিয়ানসি জেলায় চেস্টনাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। শিক্ষক ইয়াং ও তাঁর স্ত্রীও একটি সুখবর পেয়েছেন। তাঁদের ছেলে চলতি বছরের কাওখাও পরীক্ষায় ভালো করে থিয়ানচিন নোর্মল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে এবং তাঁর মেজরও মায়ের মতো ক্রীড়া শিক্ষা। এ সম্পর্কে শিক্ষিকা চাং বলেন, ‘ছেলের জন্য আমাদের অনেক পরিতাপ রয়েছে, কারণ তার বড় হওয়ার পথে আমরা সবসময় অনুপস্থিত ছিলাম। মাধ্যমিক স্কুল থেকে সে বোর্ডিং স্কুলে পড়েছে। এক সপ্তাহে মাত্র একবার বাসায় ফিরে আসতো। উচ্চবিদ্যালয়ের সময় জেলার স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তখন এক মাসে একবার দেখা হতো। এবার সে থিয়ানচিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবে। স্কুলের জন্য এবারও তার সঙ্গে আমাদের যাওয়া হবে না। এটা আমাদের জন্য দুঃখের ব্যাপার।’

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছিয়ানসি জেলার শিক্ষা বিভাগ পরপর ১৭ লক্ষাধিক ইউয়ান বরাদ্দ দিয়ে লিচিয়াইয়ু প্রাথমিক স্কুল মেরামত করেছে। স্কুলের ক্লাসরুম, খেলার মাঠ, টয়লেট ও পরীক্ষাগারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নত হয়েছে। এখন স্কুলের পরিবেশ বেশ সুন্দর এবং শিক্ষকদের সংখ্যাও ধীরে ধীরে বেড়েছে।

 

শিক্ষক ইয়াং বলেন, ‘এখন স্কুলের পরিবেশ অনেক ভালো। আমরাও আরো মনোযোগ দিয়ে বাচ্চাদের পড়ানোর প্রচেষ্টা চালাবো।’

 

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)