ওয়েহাই এর শ্রমিক জাদুঘর: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অজানা ইতিহাস
2022-09-21 09:57:53


শানতং প্রদেশের উপকূলীয় শহর ওয়েহাই। শহরটি তিনদিক দিয়ে সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। অনন্য সুন্দর এই শহরটি দেখার জন্য দুই আগস্ট রাতে ইয়ানতাই থেকে আমরা (সিআইপিপিসি প্রোগ্রামের সাংবাদিকরা) চলে গেলাম ওয়েহাই। খুব বেশি দুরে নয়। বাসে মাত্র এক-দেড়ঘণ্টার যাত্রা। রাতে পৌঁছানোয় সেদিন আমাদের আর কোন কার্যক্রম ছিল না। পরদিন সকালটা শুরু হল ওয়েহাই এর শ্রমিক জাদুঘর দেখার মধ্যদিয়ে। এটি ইতিহাসের অনন্য একটি স্থাপনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অজানা একটা ইতিহাসকে ধারণ করে আছে জাদুঘরটি। ১৯১৪ সালে ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে নানা ধরনের কাজ করানোর জন্য চীন থেকে এক লাখ ৪০ হাজার মানুষকে শ্রমিক হিসেবে নিয়ে যায় সেসময়কার পরাশক্তি ইংল্যান্ড। এদের মধ্যে ওয়েহাই থেকেই নেয়া হয় ৪৪ হাজার শ্রমিককে। অস্ত্র কারখানায় কাজ করা, পরিখা খনন, দুর্গ নির্মাণ, গোলাবারুদ সরবরাহ, যু্দ্ধক্ষেত্র থেকে আহতদের উদ্ধার, মৃতদের সৎকার, যোগাযোগ, খাবারদাবার-ঔষধপত্র আনানেয়াসহ নানা ধরনের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করানো হয় এসকল শ্রমিককে দিয়ে। যুদ্ধের সাপোর্টিং কাজের জন্য চীন-ব্রিটিশ সম্পাদিত চুক্তি বলে স্থাপিত হয় চাইনিজ লেবার কর্পস। এই সংস্থার অধীনেই চীনা শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়া হয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স বুঝতে পারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সহসাই শেষ হবে না। এটা দীর্ঘায়িত হবে। সে কারণেই চীনের সাথে চুক্তি করে শ্রমিক সরবরাহের জন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া সেসকল শ্রমকিদের স্মৃতি রক্ষার্থেই নির্মাণ করা হয়েছে এই শ্রমিক জাদুঘর। 

ওয়েহাই এর হাইয়ুন পার্কে সাগরের তীর ঘেঁষে মাটির নিচে তৈরি করা হয়েছে পুরো জাদুঘরটি। মাটির নিচে এ এক অনন্য স্থাপনা। শ্রমিকদের এখানে ট্রেনিং দিয়ে এখান থেকেই জাহাজে উঠিয়ে ইউরোপ নিয়ে যাওয়া হত। সেসময় যুদ্ধের কারণে জাহাজ চলাচল সহজ ছিল না। এ কারণে জাহাজের অপেক্ষায় ২০দিন পর্যন্ত শ্রমিকদের এই জায়গায় রাখা হত। জাদুঘরের প্রবেশ পথের ৫/৬ মিটার দুরেই চোখে পড়ে ঢালু একটা সরু গলিপথ। মাত্র ৩ মিটার চওড়া গলিপথটি নেমে গেছে সাগরে। এই পথ দিয়েই ১০০ বছরের বেশি সময় আগে চীনা শ্রমিকদের ইউরোপগামী জাহাজে তোলা হত। একেক চালানে কয়েকশ” থেকে কয়েক হাজার শ্রমিককে নেয়া হত। এটা নির্ভর করতো জাহাজের আকারের ওপর। কয়েক মাসের সমুদ্র যাত্রার পর জাহাজ পৌঁছাতো ইউরোপে। দীর্ঘ যাত্রায় রোগে বা সামুদ্রিক ভোগান্তির কারণে যাত্রাপথেই মারা যেত অনেকে। তাদের সলিল সমাধি হত সাগরে। 


জাদুঘরটির আয়তন দুই হাজার ৩৪৪ বর্গমিটার। এরমধ্যে প্রদর্শনী এলাকা হল ৭২০ বর্গমিটার। জাদুঘরটিতে আছে প্রদর্শনী হল, প্রোজেকশন হল, কফি শপ, সাংস্কৃতিক পণ্যের স্টোর, অফিস রুম ও অন্যান্য ঘর। প্রদর্শনী হলে সেসময়কার শ্রমিকদের দুর্লভ কিছু ছবি, তাদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসিপত্র, হ্যাট, ব্যাগ, থালাবাটি, ডকুমেন্টস, ডায়রি, মেডেলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। এ ধরনের প্রায় দুই শ’ আইটেম স্থান পেয়েছে প্রদর্শনী হলে। এসব ঘুরে দেখতে দেখতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চীনের শ্রমিকদের অমানুষিক পরিশ্রমের দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তবে এতবড় ভয়ঙ্কর যুদ্ধের অনিশ্চয়তার মধ্যেও শ্রমিকরা নিজের দেশকে ভুলে যায় নাই। নানা উৎসব পার্বণে তারা একত্রিত হয়েছেন, আনন্দ করেছেন। কিছু কিছু ছবিতে সেসব দৃশ্য দেখে অভিভূত হলাম। শুধু যুদ্ধের সময়ই নয়। যুদ্ধ থেমে গেলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পূণর্গঠনেও তাদের কাজে লাগানো হয়। চীনা শ্রমিকদের দিয়ে রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, বিধ্বস্ত ভবন নির্মাণসহ নানা কাজ করানো হয়। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরপরই ২০ হাজার শ্রমিককে দেশে পাঠায় ইংল্যান্ড। বাকীদের পূণগর্ঠনের কাজে লাগানো হয়। অনেকেই মারা যায়। শেষ পর্যন্ত তিন হাজার শ্রমিক প্রথম অভিবাসী হিসেবে ফ্রান্সে থেকে যায়। ২০২০ সালে জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়। প্রতিবছর গড়ে দুই লাখ লোক জাদুঘরটি ভিজিট করে।    


ইমরুল কায়েস