চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের যুব-গবেষকদের আরও বেশি উন্নয়নের সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন
2022-09-19 18:14:07

আমরা সবসময় বলি যে, দক্ষ ব্যক্তি একটি দেশের উন্নয়নের মেরুদণ্ডের মতো। তাই দক্ষ ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের ওপর অনেক গুরুত্ব দেয় চীনা সরকার। বিশেষ করে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের দক্ষ ব্যক্তিদের উন্নয়ন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এক পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৯ সালের শেষ দিক পর্যন্ত চীনের ৩৯ বছরের কম বয়সী দক্ষ ব্যক্তিদের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের দক্ষ ব্যক্তি ৭৮.৩৯ শতাংশ। আর যারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে অনেকের বয়স ২৫ বছর থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। বিশ্বের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের গড় বয়সও ৩৮.৭ বছর। আজকের আসরে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের যুব-গবেষকদের প্রশিক্ষণ ও উত্সাহব্যাঞ্জক ব্যবস্থা নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

 

উ এন সিউ একজন যুব-গবেষক, যিনি গত বছর ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন এবং থিয়ানচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ প্রিসিশন ইন্সট্রুমেন্ট অ্যান্ড অপটোইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপ-গবেষক হিসেবে যোগ দেন। এখন প্রতিদিন তিনি ব্যস্ত। সাফল্য অর্জনের জন্য তিনি কাজ করে যেতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কারণ, তাঁর দৃষ্টিতে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সুবিধাজনক ব্যবস্থা যুব-গবেষকদের জন্য বেশ ভালো। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আত্মউন্নয়ন ঘটানো উচিত।

তাহলে কিভাবে চীনা যুবকদের প্রাণশক্তি বাড়ানো ও নব্যতাপ্রবর্তনে উত্সাহিত করা যায়? এ সম্পর্কে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ ৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। তাতে যুব-গবেষকদের জন্য সুবিধাজনক নীতিমালা প্রস্তাব করা হয়। যুব-গবেষকদের আরও বেশি সুযোগ দেওয়া, তাদের দায়িত্ব বহন করা, গবেষণার সময় নিশ্চিত করা, মানসিক ও শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটানোসহ বিভিন্ন সুবিধাজনক নীতি চালু হয়েছে।

সংবাদদাতা যুব-গবেষকদের ওপর জরিপ চালিয়েছেন। তাদের সম্মুখীন চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা নিয়েও সাক্ষাত্কারে কথা বলা হয়েছে। উ এন সিউ যুব-গবেষকদের মধ্যে একজন। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে ভর্তি হন, তখন তাঁর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে গবেষণার জন্য তহবিলের অভাব। এ সম্পর্কে শিক্ষক উ বলেন, যুব-শিক্ষকদের গবেষণার তহবিল না-থাকলে গুণগত মানের গবেষণার কাজ হতে পারে না। আর যদি তারা কাজে কোনো সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়, তবে তারা সহজে চাকরি হারাতে পারে। অবশ্য শিক্ষক উ খুবই ভাগ্যবান। তিনি থিয়ানচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের নব্যতাপ্রবর্তন তহবিল পেয়েছেন। এ তহবিলের সাহায্যে তিনি নতুন দ্বি-মাত্রিক সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইস নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং মাত্র এক বছরেই তাঁর গবেষণা থেকে সাফল্য অর্জিত হয়।

শিক্ষক উ সৌভাগ্যবান। তবে, সাধারণভাবে যুব-গবেষকদের কাজের চাপ বেশি, বেতন তুলনামূলক কম, গবেষণার প্রকল্প আবেদনের প্রক্রিয়া জটিল। যখন যুব-গবেষকরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে চাকরি পান, তখন আলাদাভাবে তাদের নিজস্ব পরীক্ষাগার ও দল গঠন করা খুবই মুশকিলের ব্যাপার। সাধারণত তারা সহকারী গবেষক হিসেবে বিভিন্ন দলে কাজ করেন এবং ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে পেশাদার গবেষণার সুযোগ পান।

যুব-গবেষকদের বার্ষিক গবেষণা-বাজেট খুবই কম, সাধারণত গড়ে মাত্র ২০ হাজার ইউয়ান। অথচ বিভিন্ন পরীক্ষাগারের যন্ত্রপাতি ও বিকারক কেনার জন্য অনেক টাকা খরচ হয়। এ টাকা তাদেরকে অন্যান্য দিক থেকে সংগ্রহের জন্য আবেদন করতে হয়।

তা ছাড়া, তাদেরকে সিনিয়র গবেষকদের সাথে একই মানদণ্ডে যাচাই করা হয় এবং সমান সমান পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। এ সম্পর্কে কুয়াংতুং প্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যুব-শিক্ষক লি বলেন, এটি যুব-গবেষকদের জন্য অনেক কঠিন ব্যাপার। কারণ, তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রকল্পের সংখ্যা সিনিয়রদের তুলনায় অনেক কম। একই ধরনের পরীক্ষায় অংশ নিলে তারা সিনিয়রদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক।

একজন যুব-গবেষক যখন চাকরি পান, তখন তাকে অনেক সময় নিয়ে বিভিন্ন মৌলিক ও প্রশাসনিক কাজ করতে হয়। যেমন, বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের আবেদনপত্র, সারাংশ সংগ্রহ, ফর্ম পূরণ করা, ইত্যাদি। তাদের গবেষণাকাজ অফিসের অবসর সময়ে করতে হয়। যদিও পরে স্বাধীন গবেষণা প্রকল্প পেতে পারেন, তবে শুরুর দিকে বাজেট যথেষ্ট নয়। তাদেরকে নানান সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়, যা গবেষণার জন্য মোটেই অনুকূল নয়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের যুব-গবেষকরা আসলে চমত্কার উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তারা সামাজিক মর্যাদা ও ব্যক্তিগত আয়কে বেশি গুরুত্ব দেন। তবে শুরুতে যুব-গবেষক হিসেবে তাদের বেতন তুলনামূলক কম থাকে। তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের গবেষণার চাপ ও জীবনের চাপ—দুটোই তাদের সহ্য করতে হয়।

আশার কথা, যুব-গবেষকদের ওপর থেকে বিভিন্ন ধরনের চাপ কমিয়ে দিতেই একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে। আসলে, সৃজনশীল সুপ্তশক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে যুব-গবেষকদের ওপর চাপ অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। তাই তাদের চিন্তা ও উদ্বেগ কমিয়ে দেওয়া এবং তাদেরকে নিজেদের শক্তি ও মেধার বেশিরভাগটা গবেষণায় নিয়োজিত করার সুযোগ দেওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাই, এমন সুবিধাজনক নীতিমালা ও পদক্ষেপ তাদের জন্য যথাযথ ও প্রয়োজনীয়। নতুন নীতিমালা অনুসারে, চীনের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা পরিকল্পনায় ২০ শতাংশ পদ পূরণ করতে হবে ৪০ বছর বয়সের নিচের যুব-গবেষকদের দিয়ে। তাদেরকে দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও প্রধান কর্মীর পদ দিতে হবে। আর চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির নতুন প্রকল্পের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বয়স ৪৫ বছর চেয়ে কম হলে ভালো এবং এ সংখ্যা ৫০ শতাংশের চেয়ে কম হবে না।

তা ছাড়া, বিভিন্ন মৌলিক গবেষণার বাজেট ও তহবিল আবেদনে যুব-গবেষক, ডক্টরেট শিক্ষার্থী ও নারী বিজ্ঞানীদের জন্য আরো বেশি সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। চীনের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সরকারি গবেষণাগার ও সরকারের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মৌলিক গবেষণা বাজেটের নির্দিষ্ট অংশ যুব-গবেষকদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যুব-গবেষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ প্রকল্পও চালু করতে হবে। এটি যুব-গবেষকদের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন, কারণ যুবকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নব্যতাপ্রবর্তনের দক্ষতা অর্জন সবচেয়ে ভালো। যদি এসময় তারা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অংশ নিতে না-পারে, তাহলে সহজে আত্মউন্নয়নের সেরা সুযোগ হারিয়ে যাবে। বয়স বাড়লে নব্যতাপ্রবর্তনের ও সৃষ্টিশীলতা কমার আশঙ্কা বেশি।

বিভিন্ন সুবিধাজনক নীতি ছাড়া, মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা ব্যবস্থাও যুব-গবেষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যদি উপযোগী ও উত্সাহব্যাঞ্জক পর্যালোচনা ব্যবস্থা থাকে, তাহলে চাপ হ্রাস করার পাশাপাশি যুবকদের আত্মউন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাও বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ সম্পর্কে চীনের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ভাষা একাডেমির অধ্যাপক কুও ইং চিয়ান বলেন, চাপ হ্রাস কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য যুবকদের আত্মউন্নয়নের সমস্যা মোকাবিলা করা। যদি উপযোগী পর্যালোচনার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়, তাহলে যুব-গবেষকদের গড়ে তুলতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।

এবারের নতুন পর্যালোচনা ব্যবস্থায় চীনের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রকল্প ও তহবিলে বিভিন্ন প্রতিবেদনের সংখ্যা কমানো হয়েছে। এতে যুব-গবেষকদের সময় বাঁচবে। তা ছাড়া, প্রকল্পের পর্যালোচনার মেয়াদ স্থগিত করা হয়েছে আর  ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, যুব-গবেষকদের বাস্তব কার্যক্রমের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে, যাতে যুব-গবেষকদের ফরম একাধিকবার পূরণ করতে না-হয়।

চীনের ছিংতাও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা বিভাগের পরিচালক লি রোং কুই’র দৃষ্টিতে এবারের চাপ হ্রাস কার্যক্রমে কেবল যুব-গবেষকদের গবেষণাকাজের ওপর মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, তা নয়, বরং তাদের স্বাভাবিক জীবনের সামনে বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; যুব-গবেষকদের নিয়মিত মানসিক পরামর্শ, বিনোদন তত্পরতা, দৈনিক শরীরচর্চাসহ বিভিন্ন বিষয়ে টিপস দেওয়া হয়েছে। সেটিও ভালো খবর। এখন আর সারাদিন যুব-গবেষকদেরকে গবেষণায় ডুবে থাকতে হবে না। তারা দম ফেলার সময় পাবেন এবং নিজেদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার সুযোগ পাবেন।

শিক্ষক লি আরও বলেন, নতুন চাপ হ্রাস নীতি চালুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক যুব-শিক্ষকের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছে। তারা নতুন নীতির আওতায় নতুন প্রকল্পের জন্য আবেদন করতে চায়। স্থানীয় সরকার সুবিধাজনক নীতি বা ব্যবস্থা চালু করাতে তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। তারা এখন  সংশ্লিষ্ট গবেষণা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার বিস্তারিত জানতে আগ্রহী। মোদ্দাকথা, যুব-গবেষকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ প্রদান, গবেষণার দায়িত্ব দেওয়া, এবং তাদের সংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যে প্রয়োজন, তা এখন সবাই স্বীকার করেছেন।

বেইজিং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্যু সিয়াও মিং একজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। যুব-গবেষকদের জন্য দেশের দুই দফার চাপ হ্রাস কার্যক্রমে তিনি উপকৃত হয়েছেন এবং এ প্রক্রিয়ায় তিনি যুব-গবেষকদের উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা উপলব্ধি করেছেন। তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, যুব-গবেষকদের পরীক্ষার চাপ হ্রাস করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পদোন্নতি ও স্বীকৃতির ব্যবস্থা করাও দরকার। কারণ, বর্তমানের পর্যালোচক ব্যবস্থায় যুব-গবেষকদের সার্বিক উন্নয়ন দেখাতে হয়। অথচ তাদের সবার প্রাধান্য ও দক্ষতা এক নয়। তাই বহুমুখী দিক থেকে তাদের প্রাধান্য ও সুপ্তশক্তি কাজে লাগেতে উত্সাহ দিতে হবে। এভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ কোর্স বেছে নিতে পারেন যুব-গবেষকরা।(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)