গত ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ভারতে চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বড় প্রতিবেশি দেশ ভারতে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের সফর সবসময় সংশ্লিষ্ট মহলে গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
সফরকালে শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। ভারতে রাষ্ট্রপতি দ্রোপদী মুর্মু ও উপরাষ্ট্রপতি জগদ্বীপ ধনখড়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধীও সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। ভারতের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ী গৌতম আদানি ও ভারতীয় ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও শেখ হাসিনার এবারের সফরের গুরুত্বপূর্ণ দুটি কর্মসূচি ছিল।
তবে, সঙ্গত কারণেই দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠক, যৌথ সংবাদ সম্মেলন ও ঢাকা-দিল্লি যৌথ বিবৃতির ওপরই নিবদ্ধ ছিল সবার দৃষ্টি। শীর্ষ বৈঠকে দুই প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। কুশিয়ার নদীর পানিবন্টনসহ দুদেশের মধ্যে ৭টি সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরিত হয়। তবে, তিস্তা নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বা যৌথ বিবৃতিতে কোনো উল্লেখ না থাকা বাংলাদেশের মানুষকে হতাশ করেছে।
ভারত সফরের দ্বিতীয় দিনে ৬ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে দু’নেতা একান্ত বৈঠক করেন। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত মোকাবেলায় বাংলাদেশ ও ভারত একযোগে কাজ করবে বলে দুই প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকার করেন। একই সঙ্গে দু’দেশের স্থিতিশীল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেন দু’নেতা।
পরে যৌথ সংবাদ সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে একটি স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলবে ভারত। মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে সহযোগিতার কথাও বলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দুই দেশ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার চেতনায় অনেক অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করেছে। তিস্তার পানি বন্টন চুক্তিসহ অচিরেই অমীমাংসিত সব বিষয়ের দ্রুত সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শীর্ষ বৈঠকেও তিস্তা প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। যৌথ সংবাদ সম্মেলন ও যৌথ বিবৃতিতেও তিস্তা চুক্তির কথা এনেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন কিংবা যৌথবিবৃতিতে এ সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
তিস্তা নিয়ে এবার বড় কোনো ধরনের অগ্রগতি বাংলাদেশ সরকার বা জনগণ আশা করেনি। তাই বলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টিকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাবেন এমনটাও অপ্রত্যাশিত। যেখানে এবারের সফরে কুশিয়ারা নদীর পান্টি বন্টনে সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষর হয়েছে; ত্রিপুরায় সেচের জন্য ফেনী নদীর পানি বন্টনে অন্তর্বর্তী চুক্তির প্রস্তাব এসেছে ভারতে পক্ষ থেকে- সেখানে বাংলাদেশের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা তিস্তার প্রসঙ্গই আসবে না এটা কাম্য নয়। দৃশ্যত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তিস্তা ইস্যুকে হিমঘরে পাঠিয়ে অন্য অভিন্ন নদীর পানি বন্টনের বিষয়ে আগ্রহী। ভারতীয় কর্মকর্তাদের কথাবার্তায়ও এমন ইঙ্গিত স্পষ্ট। তিস্তা চুক্তির স্টেকহোল্ডার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে এবার শেখ হাসিনার সফরে দিল্লিতে আমন্ত্রণও জানায়নি কেন্দ্রীয় সরকার। এ থেকেও তিস্তার বিষয়ে ভারতের অনাগ্রহ বোঝা যায়।
তবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরে কিছু প্রাপ্তিও রয়েছে। কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহারে সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরকে তার এবারের ভারত সফরের বড় একটি অর্জন বলে দেখছে ঢাকা। এ ছাড়া ভারতের মধ্য দিয়ে তৃতীয় কোনো দেশে বিনা মাশুলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার ভারতীয় প্রস্তাবও গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
যৌথ ঘোষণায় জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্য চাল, গম, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, চিনি- প্রভৃতি পণ্যের সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। এ বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সব জরুরি নিত্যপণ্য রপ্তানিতে বিভিন্ন সময়ে ভারতের গড়িমসিতে বাংলাদেশের জনগণকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। ভারত তার এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলবে বলেই বাংলাদেশের মানুষ আশা করে।
বাংলাদেশে জ্বালানি সরবরাহে পাইপলাইন স্থাপন, আন্তঃসঞ্চালন লাইন চালুর মাধ্যমে ভারত নিজের এবং নেপাল ও ভুটানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহের কথা বলছে।
বাংলাদেশের মধ্য দেয়ে ভারতের মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগ সড়ক নির্মাণেরও প্রস্তাব দিয়েছে দিল্লি। এ ছাড়া আন্তঃসীমান্ত রেলসংযোগ কার্যকর করতে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি ক্রসিংয়ে বন্দর বিধিনিষেধ তুলে নিতেও বাংলাদেশকে অনুরোধ করা হয়েছে। দেশের স্বার্থ রক্ষা করে বাংলাদেশ এ বিষয়গুলো বিবেচনা করতে পারে।
এর বাইরে উপআঞ্চলিক সহযোগিতা, রোহিঙ্গা সঙ্কটের মতো ইস্যুগুলো নিয়ে কথা হয়েছে দুই প্রধানমন্ত্রীর। দুই প্রধানমন্ত্রী রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট এবং রূপসা সেতুসহ ভার্চুয়ালি বেশ কটি প্রকল্প উদ্বোধন করেন।
ভারতের শীর্ষ ব্যবসায়ী গৌতম আদানি ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশের সুবিধা নিয়ে আরও বেশি করে বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বাংলাদেশে বড় অংকের বিনিয়োগের আগ্রহের কথা জানান গৌতম আদানি।
সবকিছু মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে খুব বড় কিছু অর্জিত না হলেও প্রতিবেশি একটি বড় দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখা এবং সম্পর্কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহল।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।