‘তোমার জানালা থেকে বের হও’
2022-09-09 15:57:19

সঙ্গীত কোনো দেশের সীমানা মানে না। আপনি কি এখন গাড়ি চালাচ্ছেন, নাকি বাসার কোনো কাজ করছেন? আপনি এখন একা, নাকি সাথে সঙ্গী আছে? আপনার মন আজকে বেইজিংয়ের শরত্কালের নীল আকাশের মতো স্বচ্ছ, নাকি ঢাকার কালবৈশাখী সময়ের মতো মেঘলা? যে যেখানে যেভাবেই থাকুন না কেন, আসুন সঙ্গীত উপভোগ করি। সঙ্গীতের জগতে ডুব দেওয়ার আনন্দই আলাদা, কী বলেন?

বন্ধুরা, এখন যে গানটি আপনারা শুনছেন, সেটা গায়ক ফু শু-এর গান ‘দানিয়া’ । ফু শু-এর বাবা-মা দু’জনই বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ফু শু চীনের ক্যাপিটল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বছরে তিনি আর পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে পারেননি। তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্তর্হিত হয়ে মাইথিয়ান সঙ্গীত রেকর্ডিং স্টুডিওতে যোগ দিয়েছিলেন। ফু শু-এর জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়ে তার একটি রেকর্ড ৫ লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু ২০০৩ সালের পর তিনি নিজের সঙ্গীত কেরিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়ে হঠাত্ নীরব হয়ে যান। আর কোনো অ্যালবাম বের করেননি। সাফল্য তার শান্ত জীবনে অনেক চাপ সৃষ্টি করেছিল। তাই তিনি নিজেকে লুকিয়ে রেখে আর কোনো গান লিখেননি। ১৩ বছর পর তার সর্বশেষ ‘লিয়ে হু শিং জুও’ অ্যালবাম বের হয়। ‘বেবি, বিদায়’ গানটি একজন বন্ধুর জন্য রচনা করেন। এ গানের মাধ্যমে মনের বিভিন্ন অন্ধকার ভাবনার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছোন ফু শু। তা ছাড়া, রাশিয়ার সঙ্গীতের প্রভাবও এ গান থেকে অনুভব করা যায়। গানে বলা হয়েছে: অন্ধকারের ট্রেনস্ট্যান্ড থেকে সর্বশেষ রেলগাড়িটিও চলে গেছে। সেটা ছিল সম্ভবত আমাকে উদ্ধার করার শেষ আশা। পরিত্যাগ করতে চাইলে দৃঢ়ভাবে করতে হয়। বিদায় দেওয়ার সময় মান রক্ষা করতে হয়। আমার ব্যাখ্যা করার কোনো দরকার নেই। এ আমার ভাগ্য। আমার মনের মধ্যে একটি সুয়াইদান লুকিয়ে আছে। শুধু অপরিচিতি ও অমিতাচার তাকে শান্ত রাখতে পারে। আমি ভেঙে পড়েছি, আর কোনো আশা নেই। একাকী ভূতের মতো বাইরে ঘুরে বেড়াই। যে নৌকা দিয়ে অসীম যাত্রা শুরু করি, তাকে নিয়ে অন্ধকার রাতে ডুবে যাই। বেবি, বিদায়।

এখন ফু শু’র আরেকটি গান শুনুন। গানের নাম ‘নো ফিয়ার ইন মাই হার্ট’ বা আমার মনে কোন ভয় নেই।

এ গানে বলা হয়েছে: তুমি কিসের জন্য লুকিয়ে আছো? কাকে রাখার চেষ্টা করছো? কাকে খুশি করতে চাও? তুমি হাঁটু গেড়েছিলে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবী কি এ সবের জন্য তোমার প্রতি মায়া দেখিয়েছিলো? তাই তুমি ঝুঁকি নিতে ভয় পাও। তুমি দুর্ভাগ্যের মধ্যে পড়ে গিয়ে সব কিছু হারিয়ে ফেলেছো। দুই হাত দিয়ে এমনভাবে ধরার চেষ্টা করছো, যেন খাড়া পাহাড়ে উঠছো। তুমি মনে করো জীবন সম্পূর্ণ হয়েছে। হাত খুলে দু’পাশে ছড়িয়ে দিতে পারো কি না? দ্বিধাহীনভাবে পড়ে যাও। অন্ধকারে পড়ো, মাটিতে পড়ো, আকাশ ও সমুদ্রের খোলা উদাসীন কোলে পড়ো। আমাকে একবার মরার মতো ব্যথা দাও। আমার সব কিছু নিয়ে যাও, আমাকে খালি করে সব নিয়ে যাও। কেবল মারা গেলেই আমি আবার জন্মগ্রহণ করতে পারি।

২০০১ সালে উইনডোজ এক্সপি চালু হয়। এ সফ্টওয়েয়ার লঞ্চ করার সময় মাইক্রোসফ্ট ফু শু’কে তাদের সহযোগী-গায়িকা হিসেবে বেছে নেয়। এ উপলক্ষ্যে ফু শু ‘ছুং চু নি ত্য ছুয়াং খৌ’ গানটি রচনা করেন। এর অর্থ ‘তোমার জানালা থেকে বের হও’। উইনডোজ’কে চীনা ভাষায় বলা হয় ‘ছুয়াং কৌ’। ‘তোমার নিজের জানালা থেকে বের হও’ এমন আহ্বানের মাধ্যমে নতুন উইনডোজ এক্সপি-র নতুন পরিবর্তনের অর্থ বোঝায়। গানে বলা হয়েছে: পৃথিবী মাঝে মাঝে ধাঁধার মতো, মানুষকে বিভ্রান্তিত করে। কিন্তু তোমার বুকের মধ্যে উষ্ণ রক্ত তরঙ্গের মতো উত্তল হচ্ছে। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা না-করলে কিছু করা যাবে না। তোমার জানালা থেকে বের হও। দ্রুত ও দৃঢ়ভাবে এ নীরব অন্ধকার থেকে বের হও। তুমি স্বাধীন ও মুক্ত। সামনে অদূরেই তোমার জন্য উপহার রয়েছে। জীবন উজ্জ্বল বাজির মতো, তার ফুটে যাওয়ার সৌন্দর্য্য না-দেখে কেন চলে যাবে?

 ‘চাও হুয়ান’ অর্থ ডাক দেওয়া। গানে বলা হয়েছে: রাত নাকি দূরের সন্ধ্যার বাতাস? রাতে পুরনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে। শিশুবেলায় অসংখ্য তারার নিচে আমি জানি সে আসছে। বাতাসের মতো পুরনো সেই দিনগুলো। প্রেম ও বুড়ো হওয়া বন্ধুরা দূরে দূরে কোথাও আমাকে খুঁজছে। কিন্তু আমি আর ফিরে যেতে পারি না। জীবন এভাবে হারিয়ে যায়। 

 ‘হুয়াও জ্য’ অর্থ জীবিত থাকা। গানে বলা হয়েছে: এ বেচারাদের দেখ, জোহুজুর জীবিত আছে। কিন্তু তা মানে কি আমি বুঝি না। আমার অনেক স্বপ্ন এবং শক্তি আছে। আমি পৃথিবীকে বদলে দেবো। প্রতিবেশী লাও জাং আমাকে বলে, আমি যখন তরুণ ছিলাম তখন তোমার মতো উদ্দাম ছিলাম। কিছুই ভয় পেতাম না। পরে পতিত হয়ে ভীরু হয়েছি। স্বপ্নের কথা সব ভুলে গিয়ে শুধু জীবিত থাকতে চাই। আমরা সবাই খুব নরম প্রাণী। নিজের খোলসের মধ্যে লুকিয়ে থেকে বাইরের সবকিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে এ প্রতিরোধের খোলস ছেড়ে দমিত হয়েছি। যদি আনন্দে থাকতে চাই, তাহলে বিশাল পৃথিবীর কথা ভুলে যেতে হবে। আমরা সবাই এভাবে দেখে দেখে কোনোভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি।

এখন শুনুন ফু শুয়ের আরেকটি গান ‘সুং পিয়ে’ বা বিদায়। গানে বলা হয়েছে: শহরের উপকণ্ঠ এলাকায় ছাংথিং প্যাভিলিয়নের পাশে পুরনো সড়কের চারদিকে সবুজ ঘাস আকাশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। মৃদু সন্ধ্যায় বাতাস পাতলা গাছের পাতাকে নাড়ায়। বাঁশির সুর মাঝে মাঝে কানে আসে। পাহাড়-পর্বত সূর্যাস্তের আলোয় মাঝে মাঝে দেখা যায়। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা এখন কে কোথায় আছে? আমরা যেন আকাশের শেষে ও পৃথিবীর কোনায় পড়ে আছি। বিদায়ের সময় এক কাপ সুরা পান করো, সস্তা হলেও আমাদের আনন্দের সময়ের কথা মনে থাকবে। বিদায়ের পর আজকের রাতে তোমাকে ঠান্ডা রাতে একা একা থাকতে হবে।

প্রিয় শ্রোতা, গান শুনতে শুনতে অনুষ্ঠানের শেষ প্রান্তে চলে এলাম। তবে বিদায় নেওয়ার আগে ফু শুয়ের আরেকটি গান শোনাবো। গানের নাম ‘না শিয়ে হুয়া আর’ বা সেগুলো ফুল। গানে বলা হয়েছে: সে হাসির আওয়াজ শুনে আমার ফুলের কথা মনে পড়ে। তারা আমার জীবনের প্রত্যেক কোণায় ফুটে থাকে। আমি ভাবছিলাম চিরকাল তার সঙ্গে থাকবো। আজ দেখা যাচ্ছে আমরা বিছিন্ন হয়ে কে কোথায় জানি না। তারা সবাই বৃদ্ধ হয়েছে? তারা কোথায়? ভাগ্যিস তারা ফুটে থাকার সময় আমি ছিলাম তাদের সঙ্গে। ও, তার কথা মনে পড়ে। সে কি এখনো ফুটে আছে? চলে যাও। তারা বাতাসের সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু গল্প শেষ হয়নি, তবে থাক। সেকালের মনের কথা এতোদিন পার হয়ে আর থাকে কি না বলা মুশকিল। এখন এখানে চারদিক ঘাস, আর কোনো ফুল নেই। তোমাদের সঙ্গে কাটানো বছরের পর বছরের কথা ভাবলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়।

(স্বর্ণা/আলিম)