গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা সড়কপথে সরাসরি যুক্ত হয় রাজধানী ঢাকার সঙ্গে। দেশের যোগাযোগের ইতিহাসে রচিত হয় একটি বড় মাইলফলক। গোটা বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আসে অবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দু’মাস ১০ দিনের মাথায় রোববার চালু হলো ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ৮ম বাংলাদেশ চীন-মৈত্রী সেতু’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে তাঁর কার্যালয় থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ সেতুর উদ্বোধন করেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। সেতুটি উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কের পিরোজপুর জেলার বেকুটিয়ায় কঁচা নদীর উপর নির্মিত এই সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের আরও একটি স্বপ্ন পুরণ হলো। এর মাধ্যমে বিভাগীয় শহর বরিশালের সঙ্গে বিভাগীয় শহর ও শিল্পনগরী খুলনার সরাসরি সড়ক যোগাযোগে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা রইলো না। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এবং গভীর সমুদ্রবন্দর পায়রার সঙ্গে দেশের ২য় সমুদ্রবন্দর মংলা ও সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে এবং সর্বোপরি পিরোজপুরের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলো। যার ফলে সড়ক পথে এ দুই অঞ্চলের ১৬টি জেলার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ও যাতায়াতের সুযোগ তৈরি হলো। পাশাপাশি বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা জেলার সঙ্গে যশোর ও খুলনার দূরত্ব এক ঘণ্টারও বেশি কমে যাবে। আর পিরোজপুর হবে এক সম্ভাবনাময় জেলা।
২০১৩ সালের ১৯ মার্চ পিরোজপুরে এক জনসভায় কঁচা নদীর উপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতু নির্মাণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর বাংলাদেশ-চীন ৮ম মৈত্রী সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন তিনি।
চীনের মেজর ব্রিজ রিকনাইসেন্স এন্ড ডিজাইন ইন্সটিটিউট কোম্পানি লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে চায়না রেইল ওয়াচ ১৭ ব্যুরো গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড এই সেতুটি নির্মাণ করে। ১ হাজার ৪৯৩ মিটার দৈর্ঘের সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৮৯৪ কোটি টাকা। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার এই সেতুটি নির্মাণে ৬৫৪ কোটি টাকা প্রকল্প সহায়তা দিয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকার ব্যয় করেছে ২৩৯ কোটি টাকা।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে এটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৫ মাস আগেই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ শেষ করে। গত ৭ আগস্ট চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র ঢাকা সফরকালে সেতু বিভাগের কাছে এটি হস্তান্তর করা হয়।
সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত ছিল। জীবন ও জীবিকার জন্য তাদের দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হতো। এ সেতুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। মানুষজন এখন পিরোজপুরের তাজা পেয়ারা এবং আমড়া রাজধানীতে বসেই খেতে পারবেন বলেও প্রধানমন্ত্রী সরস মন্তব্য করেন। জেলার বাসিন্দারা অন্যান্যদের পাশাপাশি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন করতে পারে যা পিরোজপুরসহ ও এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে ব্যাপক বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন , বাংলাদেশ-চীন মৈত্রীর অন্য সেতুগুলোর মতোই এ সেতুও শুধু নদীর দু'পারকে সংযুক্ত করেনি, বরং বাংলাদেশ ও চীনের মানুষের হৃদয়কে আরও সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। কচা নদীর উপর নির্মিত এই সেতু বরিশাল ও খুলনাকে যেমন সংযুক্ত করবে তেমনি মংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে সড়ক পথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করবে। এই সেতু বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত করবে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত চীন সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ৮টি বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মিত হয়েছে। ১৯৮৯ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত হয় প্রথম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী। ১৯৯০ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর দ্বিতীয়, ১৯৯৩ সালে মহানন্দা নদীর ওপর তৃতীয়, ১৯৮৮ সালে পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীর ওপর চতুর্থ, ২০০২ সালে ঝালকাঠির গাবখান চ্যানেলে পঞ্চম, ২০০৮ সালে ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়কে ধলেশ্বরী নদীর ওপর ষষ্ঠ এবং ২০১৩ সালে মাদারীপুরের কাজীরটেকে আড়িয়াল খাঁ নদীর ওপর সপ্তম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মিত হয়। আর ২০২২ সালে পিরোজপুরের কঁচা নদীর ওপর নির্মিত হলো সদ্য চালু হওয়া ৮ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু।
চীনের রাষ্ট্রদূত যথার্থই বলেছেন, এ সব মৈত্রী সেতু বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট অঞ্চল তথা সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে তা বাংলাদেশ ও চীনের বন্ধুপ্রতীম জনগণকে আরও গভীর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করছে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।