বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে একটি মাত্র বীজ
2022-08-31 14:41:16


 

একটি বীজ বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে আর একটি প্রযুক্তি পারে বিস্ময় সৃষ্টি করতে। চীনা ধান গবেষণালয়ের ভবনে এ স্লোগান লেখা আছে, যা একজন তরুণের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। তার নাম ওয়াং খ্য চিয়ান। ১৯৮৩ সালে জন্মগ্রহণকারী ওয়াং খ্য ছিয়ান এখন  চাইনিজ একাডেমি অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেসের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন প্রকল্প "জিনোম এডিটিং অ্যান্ড অ্যাপোমিক্সিস" দলের প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

 

ওয়াং খ্য চিয়ান ও তার দলের প্রচেষ্টায় হাইব্রিড ধানের বীজের অব্যাহত ব্যবহার অসম্ভব থেকে তাত্ত্বিকভাবে সম্ভবে পরিণত হয় এবং এ কারণে তিনি ২০২০ সালে একটি তরুণ বিজ্ঞানী পুরস্কার পান। এ পুরস্কার প্রথম বারের মতো একজন কৃষি বিজ্ঞানীকে দেয়া হয়।

 

চীনের হাইব্রিড ধানের পিতা ও বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ ইউয়ান লং পিং একবার বলেছেন, তাঁর একটি স্বপ্ন আছে: মানুষকে দুর্ভিক্ষমুক্ত করা  পৃথিবীর সবার জন্য পর্যাপ্ত খাবার নিশ্চিত করা। আর ওয়াং খ্য চিয়ান বলেছেন, তারও একটি স্বপ্ন আছে। আর তা হল হাইব্রিড ধানের প্রজাতি তৈরি সহজ করা।

 

১৯৮৩ সালে চীনের চিয়াং সু প্রদেশের ইয়ান ছেং শহরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ওয়াং খ্য চিয়ান। অন্য গ্রামীণ ছেলেদের মতোই ছোটবেলা থেকে ধান ক্ষেতে বড় হন ওয়া খ্য চিয়ান। তিনি গ্রামের বাইরে যেতে চান এবং

 মাঠ ছাড়া জীবনযাপন করতে চেয়েছিলেন। তবে, অবশেষে তিনি ফিন্যান্স এবং কম্পিউটিং-এর মতো জনপ্রিয় মেজর থেকে বাদ পড়ে ইয়াং চৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নশিপ চলাকালে তিনি প্রথম বারের মতো জেনেটিক্স লেখাপড়ার মজার পেয়েছেন এবং বুঝেছেন যে উন্নত দেশের তুলনায় চীনের কৃষি এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। অনেক সমস্যার সমাধান ও গবেষণায় তরুণদের বুদ্ধি দরকার। তাই তখন তিনি কৃষি ক্ষেত্রে নিজের কিছু অবদান রাখতে চান এবং ধান ক্ষেতে নিজের মূল্য খুঁজে পেতে চান।

 

তারপর ওয়া খ্য চিয়ান চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের জেনেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি ইনস্টিটিউটতে স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট ডিগ্রী সম্পন্ন করে ইনস্টিটিউটতে কাজ শুরু করেন। তার বিষয় হল ধান প্রজনন এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত গবেষণা।

 

২০১৩ সালে, ওয়াং খ্য চিয়ান বিদেশে যাবার সুযোগ পরিত্যাগ করে চীনা ধান গবেষণালয়ে যোগ দিয়েছেন এবং এখানে তিনি প্রথম বারের মতো হাইব্রিড ধান এপোমিক্সিস বিশ্বের ধাঁধা সমাধানের স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি নানা ধান ক্ষেতে গিয়ে গবেষণা ও পরিদর্শন করেন এবং আবিষ্কার করেন ধান বীজ তৈরি কঠিন হওয়ার কারণে বীজের দাম অনেক বেশি। সহজে বললে, হাইব্রিড ধানের ফল বেশি ও শক্তিশালী, তবে বংশধররা এর সুবিধার উত্তরাধিকারী হতে পারে না। তার মানে একবার হাইব্রিড ধান চাষ করলে তার বীজ আগামি বছরে আবার ব্যবহার করা যাবে না। প্রতিবছর উচ্চ গুণগত মানের হাইব্রিড ধান চাষ করতে চাইলে বীজ ক্রয়ে বেশি টাকা লাগবে। সাধারণ ধান বীজের এক কেজির দাম ৬-৮ ইউয়ান; আর হাইব্রিড ধানের বীজের প্রতিকেজির দাম ৬০-৮০ ইউয়ান, এমনকি ২০০ ইউয়ানেরও বেশি।

 

বীজ লালন কর্মী ও কোম্পানির দিক থেকে দেখলে, এ বীজ তৈরির প্রক্রিয়া খুব জটিল। বীজের প্রজননে ব্যক্তি, অর্থসহ বিনিয়োগ অনেক বেশি। যদি আবহাওয়া ভাল না হয়, তাহলে বীজ তৈরি ব্যর্থ হতে পারে। তাই হাইব্রিড ধানের বীজের আধিপত্যের স্থিতিশীল উত্তরাধিকার প্রয়োজনীয় ও জরুরি একটি ব্যাপার।

 

অবশ্যই ওয়াং খ্য চিয়ানের মতোই আন্তর্জাতিক ধান গবেষণালয়, আন্তর্জাতিক ভুট্টা এবং গম উন্নয়ন কেন্দ্রসহ বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা সংস্থাও এ ব্যাপারকে গুরুত্ব দেয়। তবে, দীর্ঘসময়ে এ ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি অর্জিত হয়নি; ফলে ধাপে ধাপে এ নিয়ে গবেষকের সংখ্যাও কমতে থাকে।

 

বৈশ্বিক সমস্যা সমাধান ও দেশের চাহিদা পূরণে ওয়াং খ্য চিয়ান জেনেটিক্স ক্ষেত্রে  নিজের গবেষণা ফলাফল নিয়ে তার গবেষণা দলের সাথে ক্লোনিং বীজের মাধ্যমে হাইব্রিড ধানের স্থিতিশীল প্রজনন বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রায়শই পরীক্ষামূলক ব্যর্থতা এবং তহবিলের অভাবসহ নানা কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়। ওয়াং খ্য চিয়ান বলেছেন, নতুন প্রতিষ্ঠিত দলের জন্য এই অজনপ্রিয় দিকটিতে গবেষণা চালানোতে ব্যর্থতার ঝুঁকি বেশি। তবে, এ প্রকল্প চীনা ধান গবেষণালয় ও বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগারের সমর্থন পেয়েছে।

 

ওয়াং খ্য চিয়ান ও তার দলের সদস্যরা প্রতিদিন ধান ক্ষেতে ও পরীক্ষাগারের মধ্যে আসা-যাওয়া করে। যদিও তত্ত্বটি ভালভাবে ডিজাইন করা হয়েছে,  তবুও চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল ভিন্ন হয়। পরীক্ষাগারে ডেটাগুলো সব ঠিক হয়, তবে মাঠে সবসময় ডেটার সমস্যা হয়।

 

বার বার আশা দেখে ব্যর্থ হয় তারা। পরীক্ষার পর পরীক্ষা করে ওয়াং খ্য চিয়ান হাইব্রিড ধানের জেনেটিক তথ্যের আদান-প্রদানের সাথে সম্পর্কিত চারটি মূল জিনের খুঁজ পেয়েছেন। আর এই চারটি জিন একই সময়ে নিষ্ক্রিয় হওয়ার পর, তাদের বংশধরে যে ক্লোন বীজ পাওয়া যায় তার  বৈশিষ্ট্য ঠিক আগের প্রজন্মের হাইব্রিড ধানের মতোই হয়। ২০১৯ সালে "নেচার-বায়োটেকনোলজি" জার্নালের কভার স্টোরি হিসেবে প্রকাশিত হয় এ গবেষণা ফলাফল। তার গবেষণা যদি কাজে লাগে, তাহলে হাইব্রিড ধানের বীজের প্রজননের ব্যয় কমবে এবং কৃষকরা নিজেরা হাইব্রিড ধান চাষ করার পর তার বীজ সংরক্ষণ করতে পারবে।

 

ওয়াং খ্য চিয়ান বলেছেন, কিছু অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে; তবে, ক্লোন বীজকে অনুশীলনে ব্যবহার করা পর্যন্ত অনেক সময় লাগবে। সামনে আরও কষ্ট ও সমস্যা থাকতে পারে, তবে বীজ থাকলে আশা থাকবে। (শিশির/এনাম/রুবি)