আন্তর্জাতিক ও দেশীয় নানা বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে। সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার তাৎক্ষণিক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এতে করে কি দেশের বিদ্যুতের সংকট মোকাবিলা করা যাবে? বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়া এবং সংকট মোকাবিলা করা কি এক বিষয়?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় জুলাই মাস থেকে দেশের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন স্থগিত রাখা হয়। কারণ, জুন থেকে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ রেখেছে সরকার। তারপরই গত ১৯ জুলাই থেকে দেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। সে দিন থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে এলাকাভিত্তিক এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং শুরু হয়। যা পরে দুই ঘণ্টা করার কথা জানানো হয়। রাজধানী ঢাকার কোথাও কোথাও দুই ঘণ্টা হলেও বেশির ভাগ এলাকায় তিন থেকে চার ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে বলে গণমাধ্যমগুলোতে বলা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের সময় দুই ঘণ্টার জায়গায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টারও বেশি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সোমবার দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ঘোষণায় বলা হয়- প্রতি শুক্র ও শনিবার এখন থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন ছিল না।
পাশাপাশি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় জানায় সারা দেশকে সাতটি জোনে ভাগ করে সপ্তাহের সাত দিনই কোনও না কোনও জোনে শিল্প-কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতেই জোনভিত্তিক সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সারা দেশকে সাতটি জোনে ভাগ করে সপ্তাহের সাত দিনই কোনও না কোনও জোনে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে দিনে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যাবে।
মূলত এই সংকট শুধু বাংলাদেশেই নয়। বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও পরিস্থিতি সামাল দিতে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এরই মধ্যে বড় শহরগুলোতে নিয়ম করে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার ব্যবস্থা নিয়েছে। চলমান দাবদাহ ও খরায় ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলপথ দিয়ে জ্বালানি সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমে আসায় জার্মানিতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির রেকর্ড হয়েছে। ইউরোপের জ্বালানি সংকটে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বৈশ্বিক প্রচণ্ড তাপ ও খরার কারণে জলবিদ্যুতের জোগান দেওয়া নদীগুলোতে ও জলাধারগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও সামনের শীতে জানুয়ারিতে শিল্প-কারখানা ও সাধারণ পরিবারগুলোর জন্যও সাময়িকভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে। বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলায় জানুয়ারিতে যখন দেশটিতে তীব্র শীতের সময়, তখনই পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের বিষয়টি ভাবা হচ্ছে।
এ অবস্থায় ভালো খবর হলো বিশ্ববাজারে এখন জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করেছে এবং তার ইতিবাচক প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে।
এদিকে দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছে- বিদ্যুতের প্রাথমিক জ্বালানির জোগান না বাড়িয়ে পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হওয়ার কারণে দেশে বর্তমান বিদ্যুৎ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশি গণমাধ্যমে আশঙ্কা করা হয়, ২০২৬ সালের আগে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকটের কোনো সমাধান হবে না। কেননা, গত জুন থেকে বাংলাদেশ তরল গ্যাস আমদানি বন্ধ রয়েছে। গ্যাস, কয়লা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি- এই তিনটিই হলো বাংলাদেশের নিজস্ব জ্বালানির প্রধান উৎস। এই উৎসের সদব্যবহার করে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা করার পরামর্শ দেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাৎক্ষণিক নানা পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হতে পারে- কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয় না। বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে যে কোনো মূল্যে দেশে নিজস্ব জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলেই কেবল সফলভাবে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা করা যেতে পারে।