গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বাচ্চাদের নিয়ে উদ্ভিদ উদ্যানে বেড়াতে যাওয়া
2022-08-22 17:14:40

প্রতিবছরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে অগাস্ট মাসের শেষ দিক পর্যন্ত চীনা ছাত্রছাত্রীদের গ্রীষ্মকালীন ছুটি। এ সময় ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের হোমওয়ার্ক করার পাশাপাশি আরও অনেক মজাদার কাজ করতে পারে বা করে থাকে। শরীরচর্চা বা নান্দনিক শিক্ষার ক্লাসসহ বিভিন্ন আকর্ষণীয় বিষয়ের সাথে তারা সংযুক্ত থাকে। অধিকাংশ বাবা-মাকে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতেও  অফিস করতে হয়। ফলে তাদের পক্ষে বাসায় থেকে বাচ্চাদের যত্ন নেওয়া সম্ভব না। তাই তাদের অনেকে বাচ্চাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ-কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেন। উদ্ভিদ উদ্যানে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ সম্পর্কে জানানোর একটি কোর্স আছে। আজকের আসরে আমরা এ কোর্স সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরবো এবং উদ্ভিদজগত সম্পর্কে কিছু জ্ঞানও বিনিময় করবো।

 

চলতি বছরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে চীনের জাতীয় বোটানিক্যাল উদ্যান আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা হয়। সেখানকার বিজ্ঞান জাদুঘরও একসাথে চালু হয়। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে অনেক পিতামাতা বাচ্চাদের নিয়ে উদ্ভিদ সম্পর্কে নিজেদের ও বাচ্চাদের জানাশোনা বাড়াতে জাদুঘরে বেড়াতে যান।

 

বিজ্ঞান জাদুঘরের প্রদর্শনীহলের মোট আয়তন দেড় হাজার বর্গমিটারেরও বেশি। দুই তলার প্রদর্শনী-এলাকা ছাড়া, এখানে বাচ্চাদের হস্তকর্মের ক্লাসও রয়েছে।

 

প্রধান প্রদর্শনী কক্ষের সামনে বিশ্বের বৃহত্তম বড় ও ক্ষুদ্রতম বীজ রাখা হয়েছে। বিরাট সামুদ্রিক নারকেলের বীজ দেখে খুবই অবাক হতে হয়। কারণ, এ বীজের আকার অনেকটা বাটের মতো। তাই এর আরেকটি নাম ‘হিপ নারকেল’। বিশ্বের বৃহত্তম এই বীজের ওজন ২৫ কেজি।

 

এ সম্পর্কে বিজ্ঞান জাদুঘরের মহাপরিচালক ওয়াং খাং বলেন, সামুদ্রিক নারকেল কেবল ভারত মহাসাগরের সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের দুটি ছোট দ্বীপে পাওয়া যায়। বর্তমানে সারা বিশ্বে মাত্র ৮০০০টি নারকেল গাছ টিকে আছে। স্থানীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মানবজাতির অতিরিক্ত কাটাকাটির কারণে এ উদ্ভিদ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের বিপন্ন প্রজাতির লাল নামতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এই গাছকে।

 

একটি বীজের আকার কেন এতো বড়? সামুদ্রিক নারকেলের বিস্তারিত তথ্য জানার মাধ্যমে পৃথিবীর পরিবর্তনও বোঝা যায়। ওয়াং খাং বলেন, প্রাচীনকালে সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ আফ্রিকা মহাদেশের সাথে যুক্ত ছিল। সেই সময় এর বীজের আকার এতো বড় ছিল না। পরে পৃথিবীর প্লেট পরিবর্তনের কারণে ভারতীয় প্লেট এশিয়ার দিকে ভেসে যায়; হিমালয় পর্বত সৃষ্টির পর কিছু কিছু অংশ ভারতীয় সমুদ্রে পড়ে এবং স্থানীয় দ্বীপপুঞ্জও সৃষ্টি হয়। তখন, সামুদ্রিক নারকেলের সাথেও আফ্রিকার বিচ্ছেদ ঘটে। স্থানীয় পশুপাখির সংখ্যাও খুবই কম। তাই টিকে থাকার স্বার্থে দ্বীপপুঞ্জের উদ্ভিদের আকৃতি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। কারণ, বড় আকারের বীজ পুষ্টিগুণে বেশি সমৃদ্ধ হয়। তখন, সেটি আরও সহজে টিকে থাকতে পারে। সাধারণত, সামুদ্রিক নারকেলে ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ফুল ফোটে এবং ফল দেয়। এর ফলও কমপক্ষে ৮ বছর পর পরিপক্ক হয়। বড় আকারের ফলের মধ্যে প্রচুর পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে।

 

তবে জায়ান্ট বীজের অঙ্কুরুদ্গমে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। এটি পরিপক্ক হওয়ার পর গাছ থেকে খসে নিচে পড়ে। কিন্তু নিচে কোনো সুর্যালোক ও পুষ্টিকর উপাদান নেই। কিন্তু  প্রকৃতির রহস্যময় ব্যাপার ঘটে এই বীজের ক্ষেত্রে। জায়ান্ট বীজের মধ্যে আম্বিলিক্যাল কর্ড সৃষ্টি হয়। এই কর্ড দিয়ে জায়ান্ট বীজ দূরে সরে যেতে পারে এবং উপযুক্ত জায়গা থেকে পুষ্টিকর উপাদান গ্রহণ করতে পারে।

 

অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র বীজও জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। সেটি হল এক ধরনের অর্কিডের বীজ। এই বীজের আকার ধুলিকণার চেয়েও ছোটো। ১০ কোটি বীজের ওজন মাত্র ৫০ গ্রাম। পর্যটকরা কেবল মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে এই বীজ দেখতে পারেন। এ ধরনের ক্ষুদ্র আকৃতির বীজ একবারে প্রচুর পরিমাণে উত্পন্ন হয়। সেগুলো ধুলোর মতো নানান জায়গায় ভেসে যায় এবং সহজে এটি অঙ্কুরিত হয়। একটি অর্কিডের ফল থেকে হাজার হাজার বীজ পাওয়া যায়।

 

বিজ্ঞান জাদুঘরে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ সম্পর্কে আরও অনেক মজার মজার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, প্রদর্শনীতে ধান, গম, চা এবং কফিসহ বিভিন্ন উদ্ভিদ ছাড়া, শাকসবজিও দেখা যায়।

 

বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ নিয়ে কিছু মজার গল্পও রয়েছে। যেমন, লাল মরিচ চীনাদের অভিবাসনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। লাল মরিচ দেখলে অনেকে চীনের সিছুয়ান প্রদেশের খাবারের কথা স্মরণ করেন। কারণ, সিছুয়ান প্রদেশের লোকেরা ঝাল খাবার খেতে বেশ পছন্দ করে। কেবল উষ্ণ ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় আরাম পেতে মরিচ খাওয়া হয়, এমন নয়; এর পেছনে অন্যান্য কারণও রয়েছে। এ সম্পর্কে ওয়াং খাং বলেন, অতীতে সিছুয়ান প্রদেশের লোকরা ঝাল খাবার খেতো না। তবে ছিং রাজবংশ আমলে তথা ৩৯০ বছর আগে থেকে চীনের হুনান ও কুয়াংসি থেকে অনেক লোক সিছুয়ান প্রদেশে অভিবাসন করেন। তাদের দেখাদেখি সিছুয়ানের মানুষও ঝাল খাবার খেতে শুরু করেন। সেই সময় লবণ উত্পাদন ও পরিবহন অনেক চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ছিল। কিন্তু লাল মরিচের চাষাপাদ ছিল সহজতর। এ কারণেও সিছুয়ান প্রদেশে লাল মরিচ খাওয়ার রীতি প্রচলিত হয়। অনেকে ঝাল মরিচ খেতে পারেন না। কিন্তু  পোকা বা পাখিরা তা সহজেই খেতে পারে। ফলে এসব পোকা ও পাখির মাধ্যমে লাল মরিচের বীজ দূর-দূরান্তেও ছড়িয়ে পড়ে। এ ভাবে চীনে মরিচের চাষাবাদও বৃদ্ধি পায়।

 

আর্টেমিসিনিন আবিষ্কারের আগে মানবজাতি কিভাবে ম্যালেরিয়ার চিকিত্সা করতো?

চীনের ভেষজ ওষুধ সমৃদ্ধ। ভেষজ ওষুধ প্রদর্শনী-এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ভেষজ ওষুধ পাওয়া যায়। ২০১৫ সালের অধ্যাপক থু ইয়ো ইয়ো নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তখন থেকে তার আর্টেমিসিনিন আবিষ্কারের গল্প ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে জানতে পারেন যে, আর্টেমিসিনিন দিয়ে ম্যালেরিয়ার চিকিত্সা করা হয়। আসলে, প্রাচীনকাল থেকে ম্যালেরিয়া রোগ মানবজাতিকে অনেক ভুগিয়েছে। অধ্যাপক থু ইয়ো ইয়ো গত শতাব্দীর ৭০-এর দশকে আর্টেমিসিনিন আবিষ্কার করেন। প্রশ্ন হচ্ছে: এর আগে, মানে গত কয়েক শ বছর মানবজাতি কিভাবে ম্যালেরিয়ার চিকিত্সা করতো? প্রদর্শনী থেকে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়: কুইনাইন দিয়ে। এটি সিনকোনা গাছের ছাল থেকে সংগৃহীত এক ধরনের ভেষজ ওষুধ।

 

উদ্ভিদ জ্বালানিসম্পদের একটি উত্স। প্রাচীনকালের অসংখ্য উদ্ভিদ আজকের কয়লায় রূপান্তরিত হয়েছে। জ্বালানিসম্পদের সাথে জড়িত উদ্ভিদ প্রচুর। কিছু কিছু উদ্ভিদ তেল বা মদ সৃষ্টি করতে পারে। ক্যাস্টর চীনাদের জন্য সুপরিচিত উদ্ভিদ। গত শতাব্দীতে চীনের গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারে সেটি চাষাবাদ করা হতো। অনেকে জানেন না যে, ক্যাস্টরের ভুমিকা কী?  প্রদর্শনী থেকে বোঝা যায় যে, ক্যাস্টর লিপিডসমৃদ্ধ। এটা খাওয়া যায় না, শিল্পজাত পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বিমান, জাহাজ ও গাড়ির জ্বালানিসম্পদ হিসেবে এর ব্যবহার আছে।

 

আরেকটি মজার বিষয় প্রদর্শনী থেকে জানা যায়। আখ দিয়ে গাড়ির জ্বালানি তৈরি করা যায়। আখের রস থেকে চিনি তৈরি করার পাশাপাশি কৃত্রিমভাবে ইথানল তৈরি করা যায়। সেটি তেলের মধ্যে রেখে গাড়ির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আখ থেকে সংগৃহীত ইথানল তৈরির প্রক্রিয়াও সহজ; এর কার্যকারিতা ভালো; দূষণমুক্তও বটে।

সুপ্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের বিদ্যাবার্তা এ পর্যন্ত। আপনারা আমাদের অনুষ্ঠান সময়মতো শুনতে না পারলে আমাদের ওয়েবসাইটে শোনা যায়, আমাদের ওয়েবসাইট ঠিকানা Bengali.cri.cn,ফেসবুক অ্যাকাউন্ট CRIbanglaথেকেও প্রতি সোমবার আমাদের অনুষ্ঠান শোনা যায়। তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আগামী সপ্তাহের একই দিনের একই সময় আবার কথা হবে, যাইচিয়ান। (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)