দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে ৯ আগস্ট থেকে ধর্মঘট করছেন বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা। আন্দোলনের ১২তম দিনে শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে সরকার, মালিকপক্ষ ও শ্রমিক নেতাদের বৈঠকে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিভাগীয় শ্রম দপ্তর কার্যালয়ে ওই বৈঠকের পর শ্রমিক নেতারা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখানোর কথা বলে আপাতত ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। তবে সাধারণ শ্রমিকরা তাৎক্ষণিকভাবে তার এ ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে মজুরি অন্তত ২০০ টাকা করার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে রোববারও শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। অর্থাৎ দৃশ্যত চা শ্রমিকদের আন্দোলনকে ঘিরে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছিল তার কোনো সুরাহা হয়নি। এতে বড় ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছে চা শিল্প।
বাংলাদেশে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জে ১৩৫টি, চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটিতে ২৩টি আর পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে ৯টি মিলিয়ে ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগান রয়েছে। এ সব বাগানে কাজ করে প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক।
২০২১ সালে দেশে চা উৎপাদিত হয়েছে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৬ হাজার কেজি। যার বেশির ভাগ প্রায় সাড়ে ৯ কোটি কেজিই ব্যবহৃত হয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ ভোগে। তারপরও ১৮ কোটি টাকার বেশি রপ্তানি আয় এসেছে এ খাতটিতে। বিশ্বে চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ৩ শতাংশের মতো হলেও ধীরে ধীরে আমাদের চা বিশ্ববাজারে প্রভাব বিস্তার করছে। কিন্তু বর্তমান সংকটে দেশের চাহিদা মেটানোই কঠিন হবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, রপ্তানি তো পরের কথা।
চা সংগ্রহের এ ভরা মৌসুমে শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ার কথা বলছেন মালিকরা। ধর্মঘটের আগে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি আর তাপদাহে চা উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। পরবর্তীতে লোডশেডিংয়ের কারণেও বিঘ্ন ঘটছে উৎপাদন প্রক্রিয়ায়।
চা সংসদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ধর্মঘটে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ১৫ কোটি টাকা। এরই মধ্যে ৮০ কোটি টাকার চা পাতা নষ্ট হয়েছে। প্রায় দু’সপ্তাহ পাতা না তোলায় সেগুলো কেটে ফেলতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গোটা চা গাছই কেটে ফেলত হতে পারে। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ এরই মধ্যে ৫০০ কোটি টাকা বলে দাবি তাদের। ধর্মঘট আরও দীর্ঘায়িত হলে দেশের চা শিল্প যে গভীর সংকটে পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দৃশ্যত বর্তমান এ সংকটে মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। সরকারের মধ্যস্থতার প্রথম উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মালিকপক্ষ অবাঞ্ছিত শ্রমিক ধর্মঘটকে দুষছেন। কিন্তু শ্রমিকরা বলছে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে ১২০ টাকা দৈনিক মজুরিতে তারা কিছুতেই সংসার চালাতে পারছেন না। মালিকপক্ষের কাছে বহু আবেদন-নিবেদনে কাজ না হওয়ায় তারা ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
অন্যদিকে মালিকপক্ষ বলছে, শ্রমিকদে মজুরি আপাত দৃষ্টিতে কম মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয় হয়। এর মধ্যে থাকার জায়গা, ভর্তুকিমূল্যে রেশন, চিকিৎসা ইত্যাদি রয়েছে। ক্যাশ এন্ড কাইন্ড মিলিয়ে তাদের প্রকৃত মজুরি ৪০০ টাকার মতো দাঁড়ায় বলে দাবি মালিকপক্ষের। সিলেট অঞ্ল ও চট্টগ্রামের চা বাগানগুলোতে এ পদ্ধতি চালু। অন্যদিকে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের চা বাগানগুলোতে নগদ ৪০০ টাকা দৈনিক মজুরি দেওয়া হয়। তবে সেখানে রেশনের ব্যবস্থা নেই।
মালিকরা দাবি করছেন এমনিতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু গত ক’বছর ধরেই নিলাম পদ্ধতির কারণে চায়ের দাম তেমন বাড়েনি। সরকারের প্রণোদনার পরও তাদের নতুন করে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমিকদের মজুরি আরও বাড়াতে গেলে তাদের পক্ষে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হবে। তাতে শ্রমিকরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মালিকপক্ষের বক্তব্যে কিছু সত্যতা রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা খুব লোকসান দিয়ে চা বাগান চালাচ্ছেন বিষয়টা এমনও নয়। দেশের বেশিরভাগ চা বাগানের মালিক ধনাঢ়্য ব্যবসায়ীরা। তারা মুনাফার জন্যই চা বাগান চালাচ্ছেন এবং কমবেশি মুনাফা করছেনও।
অন্যদিকে, চা শিল্পে জড়িত শ্রমিকরা বাস্তবিক অর্থেই ভালো নেই। কখনও ছিলও না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশের দেড় লাখ চা শ্রমিকদের ৭৪ শতাংশই হতদরিদ্র। ক্যাশ এন্ড কাইন্ড মিলিয়েও তাদের মজুরি পর্যাপ্ত- এটা বলা চলে না। ২৫ টাকা মজুরি বৃদ্ধি এ দুর্মূল্যের বাজারে কোনো বিচারেই ন্যায়সঙ্গত নয়। অনেকেই একে পরিহাস হিসেবে গণ্য করছেন। তাই চা শিল্পের স্বার্থেই শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিটি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।