২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ৫৫তম আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফির বার্ষিক প্রতিযোগিতায় পাও ইয়োং ছিংয়ের শিল্পকর্ম শতাধিক দেশের ৪৮ হাজারেরও বেশি শিল্পকর্মকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়। তিনি বার্ষিক চ্যাম্পিয়ন হন এবং ২০১৯ সালে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার খেতাবও লাভ করেন। চীনা ফোটোগ্রাফার এই প্রথমবারের মতো এই পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির বার্ষিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম এবং ব্রিটিশ বিবিসি ‘ওয়াইল্ডলাইফ’ ম্যাগাজিন যৌথভাবে আয়োজিত শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিযোগিতাটিকে আন্তর্জাতিক পরিবেশগত ফটোগ্রাফি শিল্পের ‘অস্কার’ বলা যেতে পারে। সারা বিশ্বের ফটোগ্রাফারদের জন্য মনোনীত হওয়াও একটি বড় সম্মান। এর আগে চীনে মাত্র তিনজন ফটোগ্রাফার এই পুরস্কার জিতেছিলেন, কিন্তু তাদের কেউই বার্ষিক চ্যাম্পিয়নশিপে পুরস্কৃত হয়নি।
পাও ইয়োংছিং-এর পুরস্কার বিজয়ী শিল্পকর্ম ‘জীবন ও মৃত্যুর শোডাউন’। এতে একটি তিব্বতি শিয়ালের একটি মারমোট শিকার করার ছবি দেখায়: তিব্বতি শিয়াল এবং মারমোটের চেহারাটি খুব অভিব্যক্তিপূর্ণ, যা নিখুঁত মুহূর্তটিকে পূর্ণ করে তোলে।
এই ছবি পাও ইয়োং ছিং তার জন্মস্থানে ছিংহাই প্রদেশের হাইসি মঙ্গোলীয় জাতি ও তিব্বতি জাতির স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের থিয়েন চুন জেলার থিয়েন চুন পাহাড় থেকে তোলা হয়েছে।
বন্য প্রাণীদের ছবি তোলার জন্য পাও ইয়োংছিং সাত বছর ধরে মালভূমিতে তুষার-ঢাকা পর্বতে আরোহণ করেছেন।
‘ফটোগ্রাফিক দৃষ্টিকোণ থেকে- এটি ছিল নিখুঁত সময়। এত চমৎকার মিথস্ক্রিয়া ক্যাপচার করা আশ্চর্যজনক!’ পুরস্কার উপস্থাপনের সময় বিচারক চেয়ারম্যান রোজ কিডম্যান কক্স প্রশংসা করে বলেন-
‘পুরষ্কার জেতার বিষয়ে আমাকে সত্যিই কী খুশি করে?’ পাও ইয়োংছিং সাংবাদিককে বলেন, ‘আমি ক্যামেরা ব্যবহার করে বিশ্বকে আমার জন্মস্থান দেখিয়েছি এবং সেটি হলো বন্য প্রাণীদের আদি শহর ও স্বর্গ।’
অনেক বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফির কাজ থেকে আলাদা, পাও ইয়োংছিং-এর লেন্সে শক্তিশালীরা দুর্বলকে খাওয়ার আইন ছাড়াও, ক্যামেরার মুখোমুখি হওয়ার সময় বন্যপ্রাণীরা বেশিরভাগই প্রাকৃতিক, মুক্ত এবং আরামদায়ক অবস্থায় থাকে।
তিনি সর্বদা বন্য প্রাণীদের সবচে প্রাণবন্ত অবস্থার ছবি তুলতে পারেন: তুষার চিতাবাঘ তাদের লেজ দিয়ে ঢেকে তাদের শাবকগুলোকে স্তন্যপান করায়, হোজেনগুলো একে অপরের সাথে খেলে, ফেরেটগুলো তাদের মুখে ছোট ছোট ফুল নিয়ে তুষার থেকে উঁকি দেয়... পাও ইয়োং ছিং-এর ক্যামেরার সামনে প্রাণীগুলোকে খুব স্বাভাবিক দেখায়। মনে হচ্ছিল তারা ফটোগ্রাফারের উপস্থিতি অনুভব করতে পারছে না।
তিনি যে কষ্ট করেছেন, সে বিষয়ে তিনি কথা বলতে চাননি, শুধু বলেছেন যে, তিনি খুব ভাগ্যবান। বন্য প্রাণীদের বিরক্ত না করার জন্য তিনি তার ‘অস্তিত্বের প্রভাব’ দূর করার বিষয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেছিলেন।
বন্যপ্রাণীদের সাথে আরও ধীরে ধীরে কাজ প্রয়োজন। প্রথমে তিনি তাদের কাছ থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে দাঁড়াতেন। প্রতি ১-২ ঘণ্টা পর তিনি দশ মিটারের মতো এগিয়ে যান, যাতে বন্যপ্রাণীগুলো ধীরে ধীরে তার সঙ্গে পরিচিত হয়। তাদের কাছ থেকে ১০০ মিটার দূরে থাকে। এভাবে ১-২ ঘণ্টা থাকার পর বাড়িতে ফিরে যান তিনি।
পরদিন তিনি আবার আগের দিনের জায়গায় এসে অব্যাহতভাবে প্রতি ১-২ ঘণ্টা অপেক্ষা করে সামনে দশ মিটারের মতো এগিয়ে যান। এভাবে কয়েকদিন পর বণ্যপ্রাণীগুলো তার উপস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। এরপর তিনি ক্যামেরা দিয়ে তাদের ছবি তোলা শুরু করেন।
৫৫তম আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফির বার্ষিক প্রতিযোগিতায় যে ছবিটি পুরস্কার জয় করেছে- ছবির সেই মুহূর্ত ধারণ করতে তিনি প্রায় তিন মাস সময় দিয়েছেন।
একবার পাও ইয়োংছিং একজন পশুপালকের বাড়িতে যান এবং তাদের সন্তানদের সঙ্গে আড্ডা দেন। তিনি শিশুদের জিজ্ঞাস করেন যে, সম্প্রতি তারা কি ওটোকোলোবাস ম্যানুল (Otocolobus manul) দেখেছে কিনা। শিশুরা মনে করতো- এটা বিড়াল।
শিশুদের কথা শুনে পাও ইয়োংছিং বুঝতে পারেন, আমাদের সন্তানরা নিজেদের জন্মস্থানের প্রাণীগুলো চিনে না, তাহলে কীভাবে হবে? তখন থেকে তিনি স্থানীয় পশু-প্রাণীর ছবি তোলার চিন্তা করেন।
পাও ইয়োং ছিং বলেন, থিয়েন চুন জেলা আমাদের বাড়ি এবং থিয়েন চুন পাহাড় নানা ধরনের প্রাণীদের বাড়ি। তিনি সবসময়ই নিজকে মনে করিয়ে দেন, পাহাড়ে প্রবেশ করলে পশুপাখির দিক থেকে চিন্তা করা উচিত্।
প্রকৃতির কাছে ‘পশু ও মানুষ একই’। এটাই পাও ইয়োংছিংয়ের সবচে বেশি বলা একটি কথা। মাঝেমাঝে মানুষ যারা নিজেদেরকে খাদ্য শৃঙ্খলের শীর্ষ বলে মনে করে, তাদের বন্য প্রাণীদের থেকে বেঁচে থাকার দর্শন শেখা উচিত্।
পাও ইয়োংছিংয়ের জন্মস্থান থিয়েনচুন জেলা কয়লা সম্পদে সমৃদ্ধ, যেখানে বিলিয়ন টন প্যাকেজড ওপেন-পিট উচ্চ-মানের কুকিং কয়লা রয়েছে। পাহাড়ে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের নিচে কালো রাস্তা দেখা যায়। কয়লা খনিগুলো একসময় থিয়েনচুন জেলার প্রধান শিল্প ছিল, যা উত্তর-পশ্চিমে এই ছোট জেলাকে ২০১০ সালে দেশের শীর্ষ ১০০টি জেলার অন্তর্ভুক্ত করে।
তবে মালভূমির ভঙ্গুর পরিবেশের মধ্যে কয়লা সম্পদ অতিরিক্ত খনন করায় নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হতে পারে। তুষার চিতাবাঘের প্রধান খাবার হল ভেড়া। কয়লা খনির কারণে সেখানে তৃণভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। ভেড়ার খাওয়ার মতো ঘাস নেই, আর তুষার চিতাবাঘের খাওয়ার মতো ভেড়াও নেই। মালভূমির তৃণভূমিতে বসবাসকারী পিকা এবং মারমোটগুলো তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে এবং তিব্বতি শিয়ালগুলো ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছে।
পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয় নীল আকাশ, স্বচ্ছ পানি ও বিশুদ্ধ জমি রক্ষার জন্য ২০১১ সাল থেকে একের পর এক স্থানীয় কয়লা খনি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক দুই বছরে সংরক্ষণের মাত্রা বাড়িয়ে পরিবেশগত পুনরুদ্ধারে ২ বিলিয়ন ইউয়ানেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে সরকার।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিং ২০১৬ সালে ছিংহাই পরিদর্শনকালে বলেন, ‘ছিংহাইয়ের সবচেয়ে বেশি মূল্যবান বাস্তুশাস্ত্র বিদ্যমান থাকা এর সবচে বড় দায়িত্ব বাস্তুবিদ্যা এবং সবচে বড় সম্ভাবনাও বাস্তুবিদ্যায়। পরিবেশগত সভ্যতা নির্মাণকে একটি বিশিষ্ট অবস্থানে রাখতে হবে, প্রকৃতিকে সম্মান করা, প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে।’ থিয়েনচুনবাসীরা সম্পাদকের কথা মনে রেখেছেন এবং তা বাস্তবায়নে ঘনিষ্ঠ মনোযোগ দিয়েছেন।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কিছু ওয়াইলন্ডলাইফ ফটোগ্রাফার ছবি তোলার জন্য বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়ান, বিশেষ করে আফ্রিকা এবং আমাজনে।
‘আমি থিয়েনচুনে আছি। আমি আমার জন্মস্থানের পশুদের ছবি তোলা শেষ করতে পারছি না, আমি আর কোথায় ছবি তুলতে যাবো?’
পাও ইয়োংছিং আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফি বার্ষিক প্রতিযোগিতার পুরস্কারের স্বাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অনুবাদকদের মাধ্যমে সারা বিশ্বের ফটোগ্রাফারদের সাথে চ্যাট করেছেন। তারা জানতে চায় যে, সে কোথা থেকে এসেছে, সে তার নিজের জন্মস্থানের নাম বলে, কিন্তু বিদেশিরা তার কথা বুঝতে পারে না। তখন সে বলে ছিংহাই-তিব্বত মালভূমি। তারপর তারা তাকে জিজ্ঞাস করেন, সেখানে তিব্বতি অ্যান্টিলোপ ছাড়া, আর কোনো প্রাণী আছে কি?
পাও ইয়োংছিং উত্তরে বলেন, আরো আছে চিতাবাঘ। তারপর পাও ইয়োংছিং নিজের সেলফোন খুলে তাদের ছবি দেখানো শুরু করেন। তিনি গৌরবের সাথে তাদের বলেন, আমার জন্মস্থানে খুব সহজেই এসব বিরল প্রাণী দেখা যায়। আপাদের স্বাগত জানাই।