অর্থনৈতিক সঙ্কটের আবর্তে উল্টো পথে হাঁটা বাংলাদেশ
2022-08-14 19:42:44


ভর্তুকি আর লোকসান কমানোর কথা বলে গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকার জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বাড়ায়। ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন, পেট্রোলের দাম বাড়ে নজিরবিহীন মাত্রায়- ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, অর্থনীতি যখন একটা গভীর সংকটের আবর্তে, জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষের যখন দিশেহারা অবস্থা- তখনি জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বাড়ানোটা দেশের অর্থনীতির জন্য একটা বড় অশনি সংকেত নিয়ে এসেছে। 

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরপরই দেশে নিত্যপণ্যসহ প্রায় সবধরণের পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির বাজারদরের তালিকা থেকেই এমন তথ্য মিলছে। দেশের পরিবহন, শিল্প, কৃষি সব খাতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। গত জুনে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। জুলাইয়ে তা কিছুটা কমে সাড়ে ৭ শতাংশের নিচে নামলেও তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আগস্টে মূল্যস্ফীতি ফের বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের। সার্বিকভাবে এটা দেশের অর্থনীতির জন্য বিপর্যয়কর হবে বলে মনে করছেন বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক।  

জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্য বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য সংকট তৈরি করেছে- সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও এটা স্বীকার করছেন। এ সংকটের কথা তাদের আগে থেকেই না জানবার কথা নয়। তাহলে কেন তারা এমন একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলেন?

সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, জ্বালানি তেল আমদানিতে বড় অংকের ভর্তুকি দিতে হয়। এ ভর্তুকির বোঝা সরকারের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বলছে ভিন্ন কথা। সরকারেরই তথ্যসূত্র ইকোনমিক রিভিউ ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৪-১৫ সাল থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার জ্বালানি তেল আমদানিতে কোনো ভর্তুকি দেয়নি। বরং এ সময়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিপিসি বিশ্ব বাজার থেকে কম দামে  জ্বালানি তেল আমদানি করে বেশি দামে বিক্রি করে বিরাট অংকের মুনাফা করেছে- যার পরিমাণ ৪৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে এ মুনাফার একটা বড় অংশ স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা আছে। 

তবে এ কথা সত্য যে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ায় গত ক’মাসে বিপিসিকে কিছু লোকসান গুণতে হয়েছে- যার পরিমাণ বলা হচ্ছে ৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এ জন্যও তেলের দাম বাড়ানোর যুক্তি দেখেন না অর্থনীতিবিদরা। 

তারা বলছেন, সরকার গত ক’বছর কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করে বিশাল অংকের মুনাফা করেছে। তাই গত কয়েক মাসের লোকসানটা বিপিসি মুনাফার অর্থ থেকে সমন্বয় করে নিতে পারতো- এ জন্য অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষকে এত বড় একটা বিপদে ফেলার কোনো দরকার ছিল না। রাষ্ট্রীয় একটা প্রতিষ্ঠানের শুধু মুনাফার কথা চিন্তা না করে মানুষের কল্যাণ এবং সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির কথা ভাবাটাই সঙ্গত। তেল আমদানিতে যে অর্থটা সরকার দেয় সেটাও তো জনগণেরই টাকা। 

দ্বিতীয়ত, সরকার তেল আমদানি থেকে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক নিয়ে থাকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত। টাকার অঙ্কে সেটা প্রায় ৯ হাজার কোটি। সরকার যদি এ শুল্কটা কমিয়ে দিতো বা প্রত্যাহার করে নিতো তাহলেও তেলের এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি করা দরকার পড়তো না।  

আর এমন একটা সময়ে বাংলাদেশে তেলের দাম বেড়েছে মন্দার আশঙ্কায় যখন বিশ্বে তেলের দাম ২০ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।

সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় যে প্রভাব পড়েছে সে বিষয়ে তারা সচেতন রয়েছেন। ওএমএস ও টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি চলছে বলে জানানো হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বস্তি দিতে করোনাকালের মতো নগদ প্রণোদনা দেওয়ার কথাও ভাবছে সরকার। ৩৫ লাখ পরিবার এ সহায়তার আওতায় আসতে পারে।

তবে, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ বরাবরই সরকারের এ প্রণোদনার বাইরে থেকে যায়। তাদের অনেকেই নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। 

দেশের সাধারণ মানুষের কথা ভেবে এবং সার্বিক অর্থনীতির জন্য তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন তেলের দাম একবারে ১০-১২ শতাংশের বেশি বাড়ানো কোনো যুক্তিতেই সমীচীন নয়। আর দেশের কৃষিখাতে ডিজেলে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার পরামর্শ তাদের। কারণ পর্যাপ্ত সেচ দিতে না পারলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। আর দেশ খাদ্য ঘাটতি পড়ল সে বিপর্যয় সামাল দেওয়া কঠিন হবে। 

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।