রাস্তার ফিল্ম
2022-08-11 15:51:07

পথের চলচ্চিত্র একটি চলচ্চিত্র জেনার, যার মধ্যে প্রধান চরিত্রগুলো বাড়ি ছেড়ে রাস্তা দিয়ে যাত্রা করে, সাধারণত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি দৈনন্দিন জীবন থেকে ভিন্ন রকমের।

ব্যাপক মুভি টাইপের মধ্যে একটি রোড মুভি আছে। গল্পের থিম বা সেটিং রাস্তার ভিত্তি করে সেট করা হয়। একটি স্ট্যান্ডার্ড রোড ফিল্মে বেশিরভাগ নায়করা রাস্তায় জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ করেন এবং রাস্তায় ঘটে যাওয়া নানা সিরিজের মাধ্যমে ছবির থিম সম্পূর্ণ করেন।

বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে রাস্তার থিমভিত্তিক সাহিত্যকর্ম এবং পথ-নির্ভর চলচ্চিত্রগুলোর একই ধরনের অভিব্যক্তি রয়েছে, যাত্রার প্রক্রিয়ায় প্রধান চারিত্রগুলোর আবেগ ও ভাগ্য পরিবর্তন হয়।

চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত উপাদান হিসাবে ‘রাস্তা’ গত শতাব্দীর ৩০য়ের দশকের প্রথম দিকে হলিউড চলচ্চিত্রগুলোতে দেখা যায়। রোড ট্রিপ এবং অ্যাডভেঞ্চার তখন ছিল গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা চলচ্চিত্রের প্লটকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

তবে সেই সময়ের পথ-নির্ভর চলচ্চিত্রগুলোতে ‘রাস্তার’ উপাদান প্রধানত অন্যান্য প্রধান গল্পের প্রকারের পরিচর্যায় বিদ্যমান ছিল, এমন পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। এরপর গত শতাব্দীর ৫০/৬০-এর দশক পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব ছড়িয়ে পড়ে। অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়। ১৯৫৩ সালে আইজেনহাওয়ার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর ‘কাজের বিনিময়ে ত্রাণ’ নামে ধারাবাহিক উদ্যোগ নেয়। যা হাইওয়ে নির্মাণকাজে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কাজ।

 

পরের ৪০ বছরে আধুনিক মহাসড়কগুলো আমেরিকান গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং অটোমোবাইল ও মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তার ফলে রাস্তায় ভ্রমণ সহজ হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রে মহাসড়কে দলে দলে উদ্ভ্রান্ত মোটরবাইকার তরুণও দেখা যায়।

১৯৪৮ সালের দিকে আমেরিকান লেখক জ্যাক কেরোয়াক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্যাপক মার্কিন তরুণদের বর্ণনা করার জন্য প্রথমবারের মতো ‘বিট জেনারেশন’ ব্যবহার করেন। এসব যুবক একটি সরল জীবন অনুসরণ করত, কাজ ও স্কুলকে ঘৃণা করত এবং বিশ্বে ঘুরে বেড়ানোকে আনন্দ হিসেবে বিবেচনা করত। তারা সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে প্রায় ডুবতে বসেছিল।

একদিকে চরম চেতনাশূন্যতা, অন্যদিকে বাস্তব জগতের উচ্চ-গতির নির্মাণকাজ পাশাপাশি চলছিল। হাইওয়েতে যেখানে গাড়িগুলো উচ্চ গতিতে ছুটে চলত, এক একটি গন্তব্যহীন ভ্রমণের পথে ছুটে চলা হিপ্পিরা যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব এবং পশ্চিম উপকূল জুড়ে পৌঁছে যেতো এবং তরুণদের শূন্য ইচ্ছার মানসিকতা পূরণ হয়।

 

যুগের এই প্রেক্ষাপটে গাড়ি শুধুমাত্র পরিবহনের একটি মাধ্যমই নয়, একে আরো সুগভীর আধ্যাত্মিক চেতনাও যুক্ত হয়েছে।  এটি জনগণের বিদ্রোহ এবং পালানোর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। তাই সড়কগুলো ভ্রমণের পাল্টা সংস্কৃতির প্রতীকী প্রতীক হয়ে ওঠে।

এসব উপাদান চলচ্চিত্র গ্রহণ করেছে এবং গত শতাব্দীর ৬০য়ের দশকে হলিউড চলচ্চিত্রের বাজারে ‘ইজি রাইডার’ এবং ‘Bonnie and Clyde বোনি অ্যান্ড ক্লিদে’ এর মতো প্রতিনিধিত্বকারী সড়ক-নির্ভর মুভিগুলো একটি অনন্য ফিল্ম টাইপ হিসাবে জন্মগ্রহণ করে। আর দ্রুত তা মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

‘ইজি রাইডার’ নামের চলচ্চিত্রটি আধুনিক পথ মুভি’র জন্মদাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। চলচ্চিত্রে প্রধান দুটি চরিত্র অটোসাইকেল চালিয়ে ভ্রমণ করেন। এ চলচ্চিত্রের পুঁজি বিনিয়োগ মাত্র ৪ লাখ মার্কিন ডলার ছিল। তবে তা বক্সঅফিসে আড়াই কোটি মার্কিন ডলার আয় করে। বক্সঅফিসে সফলতা পাওয়া ছাড়াও, অস্কারের ৭টি মনোনয়ন পায় ছবিটি। এমন উল্লেখযোগ্য ফলাফল থেকে এ মুভি’র প্রতি দর্শকের সমাদর প্রমাণিত হয়।

 

রোড মুভিটি বেশিরভাগ আমেরিকার সাথে যুক্ত, কারণ এটি ‘অদ্ভুত আমেরিকান স্বপ্ন, উত্তেজনা এবং উদ্বেগকে’ কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়েছে। মার্কিন রোড মুভিগুলো আমেরিকান সংস্কৃতির দুটি মূলকথার মধ্যে উত্তেজনা পরীক্ষা করে, যা ব্যক্তিবাদ এবং জনবহুলতা, যা কিছু রাস্তার ছবির দিকে পরিচালিত করে যেগুলো উন্মুক্ত রাস্তাকে একটি সমজাতীয় সংস্কৃতির সাথে ‘ইউটোপিয়ান ফ্যান্টাসি’ হিসাবে দেখায় এবং অন্যরা এটি ‘ডিসটপিয়ান দুঃস্বপ্ন’ হিসাবে দেখায় ‘চরম সাংস্কৃতিক পার্থক্য’। ইউএস রোড মুভিগুলো হাইওয়ের প্রশস্ত উন্মুক্ত, বিস্তৃত জায়গাগুলো চিত্র হিসাবে দেখায় যে ‘স্কেল ও কল্পিতভাবে ইউটোপিয়ান’ জীবনের উপরের এবং বাইরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগকে প্রতীকী করে তুলেছে।

যদিও রোড ফিল্মটি তার আমেরিকান ড্রিমের প্রকাশ ঘটিয়েছে তবে, এর অনন্য অভিব্যক্তিপূর্ণ কাজ একে অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বিকশিত করতে সক্ষম হয় এবং দ্রুত বিভিন্ন উপবিভাগ সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে রোড মুভি সম্পর্কে কথা বললে একটি বিশাল এবং বিস্তৃত ঘরনার সাথে কাজের কথা উল্লেখ করা হয়।

২০ শতাব্দীর ৮০ বা ৯০ দশকে রোড ফিল্মগুলোকে একটি যাত্রা বা ভ্রমণের গল্প বলা হয়। এমন একটি গল্প যা পথে ঘটে এবং নির্মাতারা মানুষের মধ্যে মানুষের সম্পর্ক অন্বেষণে বা বিস্তৃত সামাজিক বিষয় নিয়ে অন্বেষণ করা হয়। তাই রোড মুভি রচনায় মজাদার পরিবর্তন হয়েছে। আস্তে আস্তে মানুষ আবিষ্কার করে যে, রোড মুভিতে কমেডি, ফ্যামিলি, এথিকস, ক্রাইম, সাসপেন্স এবং অন্যান্য উপাদান যোগ করা যেতে পারে।

 

এখন পর্যন্ত রোড ফিল্মগুলো সিনেমাজগতে তাদের অনন্য আকর্ষণ ফুটিয়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখানো অনেক শিল্পকর্মই বক্স অফিস বা বড় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে নানা পুরস্কার জয় করেছে। তবে আজকের রোড ফিল্মগুলো আগের শিল্পকর্মের চেয়ে থেকে সম্পূর্ণ আলাদা চেহারা পেয়েছে।

আগের শিল্পকর্মের তুলনায় বর্তমান রোড মুভিগুলো এত বিদ্রোহী হয় না। এটা যুগের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

তবে চীনে পথ চলচ্চিত্রের বিকাশ বিশেষভাবে অনন্য। ২০০১ সালে চীনের প্রথম রোড মুভি ‘all the way’ মুক্তি পায়। এই ফিল্মের পারফরম্যান্স তেমন ভালো ছিলো না। এটা ইঙ্গিত দেয় যে, সেই সময়ে মূলধারার দেশীয় মূল্যবোধ পথের চলচ্চিত্রের তুলনামূলক মুক্ত অভিব্যক্তির সঙ্গে খাপ খায় না।

তারপর ‘Going Home’ এবং ‘Lost On Journey’ সহ বিভিন্ন মুভিতে বসন্ত উত্সব কাটাতে বাড়িতে ফিরে যাওয়াসহ চীনা জনগণের কাছে সুপরিচিত গল্প ধীরে ধীরে চীনের মুভি বাজারে পথ চলচ্চিত্রের বাজার উন্মুক্ত করেছে।

চীনের বিশাল ভূখণ্ড আছে এবং এতে বৈচিত্র্যময় পথ চলচ্চিত্রের উপাদান আছে। পথ চলচ্চিত্র রচনার কথা বলতে গেলে পথের দৃশ্য বা সম্মুখীন মানুষের তুলনায় পথের যাত্রায় প্রধান চরিত্রের বড় হওয়ার প্রক্রিয়া আরো আকর্ষণীয়।

 

‘The Great Buddha+’ নামে মুভিতে একটি কথা আছে, যা দর্শকদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে, তা হলো ‘যদিও এখন মহাকাশ যুগ, মানুষ অনেক আগেই মহাকাশযানে করে চাঁদে যেতে পেরেছে, কিন্তু তারা কখনোই অন্য মানুষের হৃদয়ের মহাবিশ্ব অন্বেষণ করতে পারে না।’

প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ আরও দক্ষতার সাথে তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর উপায় অনুসন্ধান করতে পারে। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তি সংস্থাগুলো মানুষের যাত্রাকে পৃথিবীর বাইরে প্রসারিত করেছে, কিন্তু মানুষ এখনও অভ্যন্তরীণ সমস্যায় আছে।

 

একটি স্থায়ী এবং অনন্য ধরনের ফিল্ম হিসেবে রোড ফিল্মগুলো বিভিন্ন যুগে অজানা এবং দূরবর্তী স্থান সম্পর্কে মানুষের কল্পনা বহন করতে পারে। দুই ঘণ্টার স্ক্রিন অ্যাডভেঞ্চারে মানুষ বর্তমান জীবন থেকে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে পারে।

আসলে বর্তমান যুগের রোড ফিল্মগুলো ‘সড়ক ফিল্মগুলোর বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করার’ পথে হাঁটছে। যানবাহন বা পরিবহনের মাধ্যম শুধুমাত্র বাহক হিসাবে ব্যবহার করা হয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই যুগেও এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। মানুষ নিজের সাথে ভালভাবে সহাবস্থান করতে পারে কি না এবং তাদের চারপাশের প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পর্কগুলো মোকাবিলা করতে পারে কিনা, তা নিয়ে সমসাময়িক লোকেরা উদ্বিগ্ন। এটি আজকের দিনে আরও বেশি পথের চলচ্চিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছে।

 

বর্তমানে সীমিত সময় ও স্থানে মানুষের জীবন মাঝেমাঝে নানা আকস্মিক ঘটনার কারণে ব্যাহত হয়। প্রত্যেকেই এ অবস্থা থেকে বের হতে চায়।

একটি পথের চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্র নিজেকে অনুসন্ধান করা, বড় হওয়া, পরিপক্ব হওয়া- ইত্যাদি নানা কেন্দ্রীয় বিষয়ের সঙ্গে জড়িত থাকে।

ভবিষ্যতে একদিন রোড ফিল্মগুলোকে সত্যিকার অর্থে রাস্তা এবং গাড়ির অস্তিত্ব থেকে আলাদা করা যেতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ অজানা গন্তব্য থেকে দূরে থাকবে এবং রাস্তায় যেতে থাকবে- ততদিন এমন ইচ্ছা থাকবে। রোড ফিল্মগুলো সর্বদা তাদের অনন্য জীবনীশক্তি ধরে রাখবে।

পথের চলচ্চিত্রের দীর্ঘায়ু হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র সমালোচকরা মনে করেন, পথের চলচ্চিত্রের কাহিনী আসলেই ‘Golden Fleece গোল্ডেন ফ্লিসের’ কিংবদন্তীর মতো। একদল মানুষ একটি উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করতে করতে অনেক বিপজ্জনক পথে চলে যায়। তারা আবিষ্কার করে যে, এই উদ্দেশ্যটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। পথে অর্জিত সবকিছু হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

একটি প্রকৃত যাত্রা এবং একজন ব্যক্তির বড় হওয়া ও অভিজ্ঞতা অর্জনের যাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ধরণের গল্প শেখা তুলনামূলকভাবে সহজ এবং এটি গল্প তৈরির সবচেয়ে মৌলিক অংশের মধ্যে একটি।

সম্ভবত রোড মুভির মাহাত্ম্য সিনেমার বাইরেও বিদ্যমান। সর্বোপরি, বিভিন্ন পর্দায় ও বাইরের যাত্রায় আমাদের জীবনের গল্প কখনও থামে না। লিলি/তৌহিদ/শুয়ে